মোবারক বলল, ক্ষিধে লেগেছে।
বজলু উঠে বসতে বসতে বলল, ক্ষিধে লেগেছে।
জহির বলল, ক্ষিধার চোটে পেট জ্বলে যাচ্ছে।
ভাবের রাজ্যে ভিন্নমতের স্থান নেই। সবাই সব বিষয়ে একমত হয়। এখানেও তাই। একজনের ক্ষিধে লাগলে সবার লাগতে হবে।
বজলু বলল, ক্ষিধে লাগলে মাকড়সা কী করে জানিস?
মোবারক উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইল, কী করে?
যদি পোকা মাকড় না থাকে তাহলে নিজের একটা দুটা পা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে। ক্ষিধা মিটায়।
বলিস কী?
হুঁ। পা খেয়ে ফেললেও সমস্যা নেই। মাকড়সাদের পা আবার গজায়। টিকটিকির মত। টিকটিকির যেমন লেজ গজায়। মাকড়সারও পা গজায়।
জহির সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, দোস্ত সত্যি কথা বলছিস তো?
বজলু বিরক্ত হয়ে বলল, আমি কোনদিন মিথ্যা বললাম? তোরা বুকে হাত দিয়ে বল, মিথ্যা কোনদিন বলেছি?
না, তা অবশ্যি ঠিক।
মাকড়সার পা খাওয়ার বিষয়ে যা বললাম, এটাও ঠিক। আমরা মাকড়সা হলে ভাল হত। নিজেদের পা নিজেরা খেয়ে বসে থাকতাম। কিংবা আমি খেতাম মোবারকেরটা। মোবারক খেত আমারটা।
মোবারক ঘেন্নায় মুখ কুঁচকে বলল, অসম্ভব। আমি মরে গেলেও মানুষ খাব না।
খাওয়ার ব্যবস্থা নেই বলে তুই খাচ্ছিস না। খাবার ব্যবস্থা থাকলে তুই খেতি।
খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও খেতাম না।
তুই নিজেকে বেশি চিনে ফেলেছিস?
আমাকে আমি চিনি না আর তুই চিনে ফেললি?
অবশ্যই আমি তোকে চিনি। চোর চিনতে সময় লাগে না। তুই একটা বিরাট চোর। থিফ নাম্বার ওয়ান। থিফ অফ বাগদাদের মত তুই হলি থিফ অফ ঢাকা।
মোবারক হতভম্ব গলায় বলল, আমি চোর?
বজলু বলল, অবশ্যই চোর। তুই বুকে হাত দিয়ে বল যে শালটা তুই গায়ে দিয়েছিস এটা চুরির মাল না?
মোবারক বুকে হাত দিয়ে বলল, এই শালটা আমার এক দূর সম্পর্কের মামার। মামার কাছে একটা কাজে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় মামা বললেন, আমার একটা পুরনো শাল আছে। নিয়ে যা।
এ রকম দিলদরিয়া মামা তোর আছে? এক কথায় শাল দিয়ে দিল?
হার্ট বড় লোকজন পৃথিবীতে আছে না? আমার এই মামার হার্ট খুবই বড়। সব সময় না। মাঝে মাঝে বড়। মনে কর আমার একশ টাকার দরকার। আমি যদি মামার পায়ে ধরে কেঁদে পা ভিজিয়েও দেই কোনো লাভ হবে না। আবার কোনোদিন চলে আসার সময় হুট করে বলবে–ধর রিকশা ভাড়া নিয়ে যা। বলেই একটা একশ টাকার নোট ধরিয়ে দেবে।
তুই যে শুধু চোর তাই না, তুই মিথ্যা কুমার। সমানে মিথ্যা কথা বলছিস।
আমি যদি মিথ্যা বলে থাকি তাহলে আমি অসতী মায়ের জারজ সন্তান।
জহির বলল, আহা তোরা কী শুরু করলি। চুপ কর না। সামান্য ভদকা আছে এক ঢোক করে হবে। ফিনিশিং টাচ। এখন খাবি না পরে খাবি?
বজলু বলল, এখনই খাব। পরে আবার কী?
জিনিস কিন্তু শেষ। আর কিছুই নাই।
লাগবে না। ভদকা পেটে এক ফোঁটা পড়লেই হবে।
জহির বলল, তোরা চাইলে আমি ব্যবস্থা করি। আমার কাছে টাকা আছে।
মোবারক বলল, কত টাকা আছে?
বজলু বলল, খবরদার কত টাকা আছে বলবি না। মোবারক হাপিস করে দেবে। হারামজাদা বিরাট চোর। থিফ অফ ঢাকা।
মোবারক চোখ লাল করে বলল, আমি যদি চোর হয়ে থাকি তাহলে এই মাটি ছুঁয়ে বলছি— আমি অসতী মায়ের গর্ভের জারজ সন্তান।
জহির বলল, তোরা একটু চুপ করবি? চেঁচামেচি শুরু করলি কেন?
মোবারক বলল, তাতে তোর অসুবিধা হচ্ছে? তুই ঝিম মেরে বসে আছিস বসে থাক।
জহির বলল, কোলকাতার একটা গল্প মনে পড়েছে।
জহির বছর তিনেক আগে চারদিনের জন্য কোলকাতায় গিয়েছিল। সেই গল্প তিন বছরেও শেষ হয় নি। কোনোদিন শেষ হবে বলেও মনে হচ্ছে না। যে-কোনো পরিস্থিতিতে যে-কোনো উপলক্ষে তার কোলকাতার একটা গল্প থাকে। জহির উৎসাহের সঙ্গে শুরু করল।
হয়েছে কী— রাত তখন দুটা, আমি আর শিবেন ট্যাক্সি করে যাচ্ছি। রাস্তাঘাট ফাঁকা। যাচ্ছি গড়িয়াহাটার দিকে। গড়িয়াহাটা জায়গাটা কোথায় বলি…
গড়িয়াহাটা জায়গা কোথায় বলতে হবে না। তুই গল্প শেষ কর।
আমাদের ট্যাক্সির ড্রাইভার পাঞ্জাবি। শিখ। মাথায় পাগড়ি…।
মাথায় কী বলার দরকার নাই। শিখরা মাথায় পাগড়ি পরে সবাই জানে। গল্প শেষ কর।
ট্যাক্সি যাচ্ছে। আমার ঝিমুনির মত এসেছে।
ঝিমুনির মত আসবে আবার কী? তোরতো ঝিমুনি লেগেই আছে।
প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ হার্ড ব্রেক। আমার ঘুম গেল ভেঙে। শিখ ড্রাইভার বলল, সে আর যাবে না।
মোবারক বলল, যাবে না মানে। মাঝপথে প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দেবে? ইয়ারকি? লাথি মেরে হারামজাদাকে ট্যাক্সি থেকে ফেলে দেয়া দরকার। তুই কী করলি?
আমি ভদ্রভাবে বললাম, ভাই কেন যাবেন না। সমস্যা কী?
বাংলায় বললি?
হিন্দিতেই বলেছি। ভুল হিন্দি। ট্যাক্সি ড্রাইভাররা আবার ভুল হিন্দিটাই ভাল বুঝে। সব সময় ভুল হিন্দি শুনেতো।
হিন্দিটা কী?
ভাইয়া! কেউ নাহি জায়েগি। প্রবলেম কিয়া হুয়া?
ড্রাইভার কী বলল?
ড্রাইভার বলল, বিল্লি মে কাট দিয়া।
কী বলল আবার বল।
বলল— বিল্লি মে কাট দিয়া।
এর মানে কী?
জহির রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, মানে হচ্ছে তার গাড়ির সামনে দিয়ে একটা বিড়াল চলে গেছে। বিড়ালটা রাস্তার এক পাশ থেকে আরেক পাশে গিয়েছে।
তাতে সমস্যা কী?
সমস্যা আছে। শিখ ড্রাইভাররা বিশ্বাস করে গাড়ির সামনের রাস্তা যদি বিল্লি মে কাট দেয় তাহলে মহাবিপদ। এ্যাকসিডেন্ট হবেই। তখন তারা কিছুতেই গাড়ি ঐ রাস্তা দিয়ে চালাবে না। গাড়ি রাস্তার এক পাশে নিয়ে অপেক্ষা করবে। অন্য কোনো গাড়ি যদি পার হয় তাহলেই বিল্লি কাটার দোষ কাটা যাবে।