মোবারক জবাব দিল না। তার মানে ডাইল দিয়ে শুরুর ব্যাপারে তার আপত্তি নেই। ডাইল হল ফেন্সিডিল। ইদানীং চালু হয়েছে ফেন্সিডিলের বোতলে একটা দশ মিলিগ্রাম ইউনিকট্রিন ট্যাবলেট ছেড়ে দেয়া। ট্যাবলেটটা পুরোপুরি গুলে না। আধাগলা হয়ে তলায় পড়ে থাকে। সেই পড়ে থাকা অংশটা খাওয়ার নিয়ম নেই।
ভাবে বসার প্রথম পনেরো মিনিট বেশ জটিল। একেক জন একেক মুডে থাকে। কেউ কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ বিরক্ত হয়ে যায়। কেউ রাগ করে। কেউ ধুম করে বলে বসে, না আজ শরীর ভাল না। আজ কিছু খাব না। তখন একজনকে থাকতে হয় যে সবাইকে সামলে সুমলে রাখে। সে হল সামালদার। তাকে মেজাজ খারাপ করলে চলবে না। ভাবের আসর নষ্ট হয়ে যাবে। প্রথম দশ পনেরো মিনিট কষ্ট করে পার করে দিলে বাকি সময়টা নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না। প্রথম পনেরো মিনিটের ধাক্কাটা সব সময় সামলায় জহির। কোনো বিষয়ে তার ধৈর্য নেই কিন্তু ভাবের আসরে তার ধৈর্য অসীম।
জহির ফেন্সিডিলের একটা বোতলের মুখ খুলে মোবারকের দিকে এগিয়ে দিল। মোবারক হাত বাড়াল না। বরং ছাতিম গাছে হেলান দিয়ে উদাস হয়ে গেল। জহির চিন্তিত গলায় বলল, খেতে ইচ্ছা করছে না?
মোবারক এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না।
ঘটনা খারাপ। শুরুতেই কেউ বেঁকে বসলে সমস্যা। জহির শান্ত গলায় বলল, খেতে ইচ্ছা না করলে খাস না। রোজই এই বিষ খাওয়া লাগবে তার কোনো কথা নেই। ইচ্ছা না হলে খাবি না।
জহির নিজেই বোতলে চুমুক দিল। গলা করুণ করে বলল, অনেক কষ্টের টাকায় এই বিষ কিনেছি। একজন রাগ করে চলে যাবে। একজন খাবে না। ভাল কথা। আমি খাব। আমার হল কষ্টের টাকা। আমি ছাগল কোরবানি দিয়েছি। আমি না খেলে হবে?
জহির পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করল। দলামচা সিগারেট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সাধারণ সিগারেট না। বিশেষ সিগারেট। তামাকের সঙ্গে জিনিস মেশানো হয়েছে। সিগারেটে মিশানোর জিনিসও কয়েক পদের আছে। একটা আছে সামান্য টানলেই মাথার তালু জ্বলে। আরেকটায় হাই প্যালপটিশনের মত মাথায় প্যালপিটিশন। এই দুইটাই খারাপ। জিনজির নামে একটা পাওয়া যায়— এক্সপোর্ট কোয়ালিটি। বাজারের সেরা। জহির ওস্তাদ লোক। সে জিনজির ছাড়া অন্য কিছু আনবে না। টাকা পয়সা না থাকলেও জহিরের নজর উঁচা।
জহির বলল, সিগারেটও না?
মোবারক বলল, না।
পান খা একটা। মিষ্টি পান আছে। জর্দা দিয়ে একটা পান খেলে ভাল লাগবে। ময়মনসিংহের মিকচার জর্দা। বেহেশতী জিনিস।
মোবারক না-সূচক মাথা নেড়ে নিজের সিগারেট বের করল। জহির ধরালো তার বিশেষ সিগারেট। দুজনের সিগারেটের আগুন ওঠানামা করছে। শীত শীতও লাগছে। মোবারকের গায়ে দামি শাল, মাথায় পশমি টুপি তারপরেও তারই শীতটা বেশি লাগছে। জহির তার বোতলে একবারই চুমুক দিয়েছে। একা একা ভাবের আসর শুরু করা যায় না। সঙ্গী লাগে। ভাল কাজ মানুষ একা করতে পারে। বেশির ভাগ সময় তাই করে। কিন্তু কোনো মন্দ কাজই মানুষ একা করতে পারে না। মন্দ কাজে সঙ্গী সাথি লাগে, উৎসাহদাতা লাগে। তালি বাজানোর নোক লাগে।
মোবারক বলল, তুই দেখি আজ মেলা খরচ করেছিস। এক হাজার টাকার পুরোটাই শেষ?
জহিরের মুখে সামান্য হাসির আভা। মোবারক কথা বলা শুরু করেছে। এটা ভাল লক্ষণ। এখন যদি বজলু চলে আসে তাহলেই আসর জমে যাবে। আজকের সাপ্লাই ভাল। শুধু ভাল না, খুবই ভাল। জহিরের কাপড়ের ব্যাগে ভদকার একটা বোতল আছে। পুরো বোতল না, অর্ধেকেরও কম আছে। এটা জহির ইচ্ছা করে রেখে দিয়েছে ফিনিশিং দেয়ার জন্যে। ফিনিশিং-এর জন্য ভদকার মত জিনিস হয় না। যে জাতি ভদকার মত আসলি চিজ বের করেছে সেই জাতি আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারল না। পাছায় লাথি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল এটা ভাবাই যায় না।
গাছপালার ফাঁক দিয়ে কে যেন আসছে। তার মুখেও জ্বলন্ত সিগারেট। হ্যাঁ বজলুই ফিরে আসছে। জহির নিশ্চিন্ত হয়ে নিঃশ্বাস ফেলল। তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। ভাবের আসর এখনি শুরু হবে।
বজলুকে আসতে দেখেই মোবারকের মনে হয় মুড ভাল হয়ে গেছে। সে জহিরের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, দেখি একটা বোতল। সামান্য খাব। দুই চুমুক।
জহির নিজের বোতল এগিয়ে দিল। এবং অতি দ্রুত আরেকটা বোতলের মুখ খুলল। বোতলের টিনের মুখায় লেগে হাত মনে হয় কেটেছে। রক্ত বের হচ্ছে। বের হোক। এত কিছু দেখলে চলবে না। বজলু এসে দাঁড়ানো মাত্র তার হাতে বোতল তুলে দিতে হবে। জহিরের এত আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে সে কেঁদে ফেলবে।
জমিয়ে কুয়াশা পড়ছে। চারপাশ ঝাপসা। ছাতিম গাছের পাতায় শিশির জমেছে। মাঝে মাঝে দুএকটা ফোঁটা এদের গায়ে পড়ছে। যার গায়েই ফোঁটা পড়ছে সেই বিস্মিত হবার ভঙ্গি করে বলছে, গাছ মুতে দিয়েছে। এই রসিকতায় হেসে তিনজনই গড়াগড়ি খাচ্ছে। ভাবের রাজ্যে কোনো রসিকতাই পুরনো হয় না। প্রথমবার যেমন হাসি হাসে সপ্তমবারেও তেমন হাসি হাসে। বরং বেশি হাসে। এই হাসি এই আনন্দ যে-কোনো মুহূর্তে গভীর বিষাদে রূপান্তরিত হতে পারে। এদের এখনো হচ্ছে না কারণ এরা তিন জন। আনন্দের ভাব প্রবল থাকে যখন সংখ্যায় তিন বা তিনের বেশি থাকে। দুজন থাকলে উল্টোটা হয়।
এদের পোষাক আশাকেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। মোবারকের শাল এবং মাথার টুপি জহির গায়ে দিয়ে বসে আছে। মোবারক বসে আছে গেঞ্জি গায়ে কারণ তার শার্টে ডাইল পড়ে গেছে। জহির বসে আছে, বাকি দুজন মাথার নিচে হাত দিয়ে শুয়ে আছে।