ক্যাশ বক্স ফেলে কুদ্দুস উঠে এসে মোবারকের পাশে বসল। গলা নামিয়ে বলল, গায়ের শাল কি বিক্রি হবে?
মোবারক উদাস গলায় বলল, দামে পুষালে বিক্রি।
কুদ্দুস শাল পরীক্ষা করতে করতে বলল, সেকেন্ড হ্যান্ড ব্যবহারী জিনিস। তিনশ টাকা। যদি পুষায় জিনিস রেখে যাও, কাল দাম নিবা।
পুষাল না।
পুষালে নাই। আমারটা আমি বললাম। তিনশ।
ভাল বলেছ। এখন ফুটে যাও।
কুদ্দুস যেভাবে এসেছিল সেইভাবে চলে গেল। হাসিমুখে বসল ক্যাশবাক্সে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, দুনিয়াটা বড়ই আনন্দময়।
তারা তাদের জায়গায় চলে এসেছে
তারা তাদের জায়গায় চলে এসেছে।
সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের পুলিশ ফাঁড়ির একটু পেছনে ঝাকড়া বাদাম গাছের নিচটাই তাদের জায়গা। একদিকে শিশু পার্ক, একদিকে পুলিশ ফাঁড়ি, বাকি দুদিকে ঘন ঘাছপালা। বাগানের এই অংশটা ঠিক বাগান বলে মনে হয় না । মনে হয় জংলা জায়গা। ছাতিম গাছটাকেও জংলা গাছের মতই লাগে। গাছটা নিচু, দাঁড়ালে ছাদের মত ছড়ানো ডালে মাথা লেগে যাবে। কিন্তু বসতে কোনো অসুবিধা নেই। গাছটা এমনভাবে ছড়িয়েছে যে মাথার উপর প্রকাণ্ড ছাতা ধরে আছে এমন মনে হয়। শুধু মনে হওয়া-হওয়ি না। গাছটা আসলেই ছাতার কাজ করে। একবার তারা গাছের নিচে বসে আছে নামলো ঝুম বৃষ্টি। একটা ফোঁটা পানি তাদের গায়ে পড়ল না।
মোবারকদের পছন্দের জায়গার আরো কিছু বিশেষত্ব আছে। প্রথম বিশেষত্ব হচ্ছে— সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সন্ধ্যার পর থেকে নানান ধরনের লোকজন এবং মেয়ে মানুষ ঘোরাফেরা করে কিন্তু এই দিকে কেউ আসে না। জায়গাটা ভাল না; গরম— এমন কথা প্রচলিত আছে। মাস দুএক আগে আঠারো উনিশ বছরের একটি মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। তারও আগে বর্ষার সময় মাথা নেই একটা পুরুষের শরীর পাওয়া গেছে। শরীরটা বস্তায় ভরে মুখ সেলাই করে এই ছাতিম গাছের নিচেই ফেলে রাখা হয়েছিল। মৃতদেহ পচে গলে বিকট গন্ধ ছড়ানো শুরু করার পর পুলিশ এসে বস্তা নিয়ে যায়। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়।
মুণ্ডুহীন লাশ শিরোনামে কয়েকটা প্রতিবেদন ছাপা হবার পর পাঠক এবং পত্রিকা দুইই ক্লান্ত হবার কারণে ব্যাপারটা থেমে যায়। তবে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে চা এবং চায়ের সঙ্গে অন্যসব বস্তু যারা বিক্রি শুরু করে তারা জমাটি এক ভূতের গল্প চালু করে দেয়। নিশুতি রাতে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ নাকি মাথা নেই একটা মানুষ দেখা যায়। মানুষটা বাগানের লোকদের কাছে তার মাথাটা কোথায় তা জানতে চায়।
সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। প্রেমিকা বাড়ি ফিরতে চাচ্ছে, প্রেমিক দিচ্ছে না। অন্ধকারে প্রেমিকাকে যতক্ষণ পাশে রাখা যায়। দুজনেরই ঝিম ঝিম অবস্থা। তখন মাথা নেই লাশ গাছের আড়াল থেকে শরীরটা বের করে বলবে, এক্সকিউজ মি আপা। আমার মাথাটা কোথায় বলতে পারেন?
এই ধরনের গল্প কেউ বিশ্বাস করে না, তবে পুরোপুরি অবিশ্বাসও করে না। মানুষের মনের একটা অংশ উদ্ভট এবং বিচিত্র গল্প বিশ্বাস করতে পছন্দ করে।
রাত দশটা। মোবারক, জহির এবং বজলু— তিনজনই আছে। বজলু যথারীতি গম্ভীর হয়ে আছে, কথা বলছে না। ছাতিম গাছের নিচে বসার সময় একবার শুধু বলেছে, আমার কাজ আছে। আমি দশ পনেরো মিনিট থাকব।
জহির বলেছে, থাকিস না। তোকে কি আমরা শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি? যার যার শিকল তার তার হাতে। তুই তোর শিকল বাজাতে বাজাতে চলে যা।
বজলু বলেছে, আজ কিছু খাবও না। তোরা খাওয়ার জন্যে পাছরা পাছরি করিস না।
জহির বিরক্ত হয়ে বলেছে, তুই কি কচি খোকা যে ফিডিং বোতলে করে তোকে মদ খাওয়াতে হবে? না খেলে না খাবি। চলে যেতে চাইলে চলে যা। এখনি চলে যা।
বজলু বলেছে, চলে যাব?
জহির বলেছে, অবশ্যই চলে যাবি। তোর মত বন্ধু আমি ‘ ’ দিয়েও পুছি না।
বজলু সঙ্গে সঙ্গে উঠে হাঁটা দিয়েছে। জহির বা মোবারক এটা নিয়ে মোটেও ব্যস্ত হয়নি। কারণ দুজনই জানে বজলু ফিরে আসবে। কতক্ষণে ফিরবে এটা বলা যাচ্ছে না। পাঁচ মিনিটেও ফিরতে পারে আবার ঘণ্টা দুই পরেও ফিরতে পারে। তবে কিছুদিন হল বজলু বদলাচ্ছে। অতি দ্রুত বদলাচ্ছে। তাকে কয়েকদিন না-কি ছোট রফিকের সঙ্গে দেখা গেছে। তার বন্ধুরা বজলুকে এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তবে আজ হয়ত মোবারক জিজ্ঞেস করবে। রাগ করে বজলুর চলে যাওয়া বা ফিরে আসা কোনো ঘটনা না। তবে এ রকম ঘটনা ঘটলে খুবই রাগ লাগে। নেশার জন্যে রাগটা খারাপ। যে রেগে থাকে তাকে কোনো কিছুতেই ধরে না। নেশার খরচ জলে যায়।
জহির কাঁধের ব্যাগ থেকে বোতল বের করল। জমাটি নেশা করার কিছু নিয়ম কানুন আছে। নেশার সব কিছু চোখের সামনে রাখতে হয়। ভাগ্য ভাল থাকলে সুন্দর করে সাজানো বোতল দেখলেই নেশা হয়ে যায়। নেশা তো আর কিছু না— মনের একটা বিশেষ ভাব। সেই বিশেষ ভাবে হুট করে উঠা যায় না। একতলা থেকে দোতলায় উঠতে হলে যেমন অনেকগুলি সিঁড়ি পার হতে হয়। এক ভাব থেকে আরেক ভাবে যেতেও সিঁড়ি টপকাতে হয়। কেউ দুটা তিনটা সিঁড়ি এক সঙ্গে টপকায়। কেউ সিঁড়ি টপকানোর সময় পা পিছলে পড়ে যায়, উপরের তলায় উঠতেই পারে না। আসল ভাবের জায়গায় যারা উঠবে তারা প্রতিটি সিঁড়ি আস্তে আস্তে পার হবে। কারণ প্রতিটি সিঁড়ির কিছু আলাদা মজা আছে। আলাদা ভাব আছে।
জহির বলল, পুড়িয়াও আছে। দিব?
মোবারক বলল, এখন না।
আয় ডাইল দিয়ে শুরু করি। বজলু ফিরে আসুক তখন পুড়িয়া। ডাইরেক্ট একশন।