- বইয়ের নামঃ রূপার পালঙ্ক
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
আয়নায় নিজেকে দেখে
আয়নায় নিজেকে দেখে ছেলেরা সাধারণত মুগ্ধ হয় না। অতি বুদ্ধিমান ছেলেকেও আয়নায় খানিকটা বোকা বোকা লাগে। কিন্তু মোবারক মুগ্ধ। তার মনে হচ্ছে সে নিজেকে দেখছে না, অন্য কাউকে দেখছে। তার কোনো জমজ ভাইকে। যে ভাই কলেজে অধ্যাপনা করেন। এবং যে ভাই-এর কলাবাগান টাইপ জায়গায় একটা বাড়ি আছে। বাড়ির সামনে বাগান আছে। যে ভাই তার স্ত্রী দুই ছেলেমেয়েসহ বাগানে বসে বিকালে চা খায়। চায়ের সঙ্গে হালকা নাশতা থাকে। কোনোদিন নিমকি, কোনোদিন সমুচা।
চুল আচড়ানোই ছিল, তারপরেও মোবারক আচড়ানো চুলের উপরই কয়েকবার চিরুনী চালালো। চুলের স্টাইলটা অন্যরকম করবে কি-না ভাবল। শেষে মনে হল অন্যরকম করা ঠিক হবে না। হঠাৎ করে নতুন স্টাইলে চুল বসবে না। খাড়া খাড়া হয়ে থাকবে। যা আছে তাই ভাল। শুধু ভাল না–বেশ ভাল, যাকে বলে উত্তম।
নিজেকে উত্তম করার জন্যে মোবারককে বেশ কিছু জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে— ভোর সাতটায় গোসল। শীতের শুরুতে সকালবেলা গোসল কঠিন আজাবের একটি। সেই আজাবকে সহনীয় করার জন্যে মেসের বয় মনু মিয়াকে দুটা টাকা দিয়েছিল। কথা ছিল, দুটাকার বিনিময়ে মনু মিয়া এক কেতলি টকটকে গরম পানি বালতিতে ছেড়ে দেবে। মনু মিয়া দাঁত বের করে বলেছে, চিন্তা নাই দুই কেতলি পানি ছাড়তাছি। বলক তুলা পানি। শইল্যে ফুসকা পইড়া যাইব।
মোবারক সেই পানি মাথায় ঢেলে শিউরে উঠল। হিমালয়ের বরফগোলা পানি। মনু এক ফোঁটা গরম পানিও দেয় নি। হারামজাদাটাকে এই পানিতে চুবিয়ে দিতে পারলে মন শান্ত হত। মোবারককে বরফগোলা পানি দিয়ে গোসল সারতে হল। এক প্যাকেট লেমন শ্যাম্পু কিনেছিল। প্যাকেটে চা চামুচের এক চামুচের বেশি শ্যাম্পু হবে না। তার দামই নিল চার টাকা। শ্যাম্পু দুই নম্বরী কি-না কে জানে। মাথায় ফেনা হচ্ছে না, চোখ জ্বালাপোড়া করছে। এই শ্যাম্পু দেয়ার কারণে মাথায় আরো আধাবালতি বরফ-পানি বেশি ঢালতে হল। ভদ্র সাজার এ-কী যন্ত্রণা!
মোবারকের গায়ে ইস্ত্রী করা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ডান হাতায় পানের পিকের দাগ আছে। লাল দাগ ছিল। ধোপাখানায় পাঠানোর পর লাল দাগ হলুদ হয়েছে, এবং আরো কড়া হয়েছে। হারামজাদা ধোপার পাছায় একটা লাথি মারতে পারলে ভাল হত। ভাগ্য ভাল দাগটা এমন জায়গায় যে চট করে চোখে পড়ে না। পায়জামা ছিল না বলে প্যান্টের উপর পাঞ্জাবি পরতে হয়েছে। সেই প্যান্টও সে গতকালই ইস্ত্রী করে আনিয়েছে। সবই ভাল, শুধু স্যান্ডেলজোড়া ইজ্জত মেরে দিয়েছে। স্যান্ডেলের দিকে তাকানো যায় না। মোটরগাড়ির টায়ার দিয়ে হাফসোল করোনোটা বোকামি হয়েছে। দেখেই মনে হয় ফকিরের স্যান্ডেল। ভিক্ষার জন্যে প্রচুর হাঁটাহাঁটি করতে হবে— এটা মাথায় রেখে বানানো।
একটাই ভরসা— বড়লোকরা সাধারণত পায়ের দিকে তাকায় না। এটা অবশ্যি সাধারণ বড়লোকের কথা। অতি অতি বড়লোকরা কী করে মোবারক জানে না। আজ হয়ত জানবে। একজন অতি অতি বড়লোকের কাছে যাবার জন্যেই সকাল থেকে এই কষ্ট। শ্যাম্পুর চোখ জ্বলুনি এখনো যায় নি।
বড়লোকদের কাছে ভাল সাজ পোশাকে যেতে হয়। সাধারণ প্রচলিত ধারণা— মলিন পোশাকে উপস্থিত হলে করুণা পাওয়া যায়। মোবারক নিশ্চিতভাবে জানে ধারণা ভুল। ময়লা পোশাকে লেবেনডিস সেজে গেলে বড়লোকরা নাক কুঁচকে তাকান। ভাবটা এরকম যেন পোশাক থেকে মুরগির গুয়ের গন্ধ আসছে। এই দুর্গন্ধের হাত থেকে বাঁচার জন্যে কথাবার্তা দ্রুত শেষ করে হাতটা এমনভাবে নাড়ান যেন মুরগি তাড়াচ্ছেন। মুরগি হবার দরকার কী? একটু না হয় ঝামেলা করে ফিটফাট হওয়া গেল। তবে শ্যাম্পুটা না দিলেও হত। চোখ শুধু যে জ্বালা করছে তাই না, একটু লাল লালও হয়েছে। তার মত মানুষের লাল চোখ মানায় না। লাল চোখ মানায় শুধু মেথরদের আর অতি অতি বড়লোকদের। তাদের জন্মই হয়েছে চোখ লাল করে রাখার জন্যে।
আজ সকাল সাড়ে নটায় মোবারকের এ্যাপয়েন্টমেন্ট। দেখা হবে মুখোমুখি। এই মুখোমুখি দেখা হবার জন্যে ঝামেলা কম করতে হয় নি। টেলিফোন করতে হয়েছে পাঁচবার। যে ফার্মেসী থেকে সে টেলিফোন করে, তারা একটা কলের জন্যে পাঁচ টাকা করে নেয়। যাকে বলে দুপুরে ডাকাতি। পাঁচটা কলে পঁচিশ টাকা চলে গেল। পঁচিশ টাকা কোনো খেলা কথা না। পঁচিশ টাকায় তিনবেলা খাওয়া হয়ে যায়। টেলিফোন করাও কোনো সহজ ব্যাপার না। সব সময় সাবধান থাকা। বেফাস কিছু যদি মোবারক বলে ফেলে তাহলে সব কেঁচে যাবে। বাণিজ্যের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এক ঝাকিতে সব শেষ। প্রথম টেলিফোনটা একটা বাচ্চা মেয়ে ধরল। মিষ্টি গলা। অতি ভদ্র ব্যবহার। আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?
মোবারক থতমত খেয়ে বলল, আমার নাম মোবারক। মোবারক হোসেন।
আপনি কার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন?
মোবারক পড়ে গেল বিপদে। আসলেইতো সে কার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে? শুরুতেই দেখি সব কেচে যাচ্ছে। মোবারক হড়বড় করে বলল,
পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেখে টেলিফোন করছি।
ও আচ্ছা। আপনাকে ম্যানেজার চাচুর সঙ্গে কথা বলতে হবে।
ম্যানেজার সাহেব কি আছেন?
জ্বি আছেন। ডেকে দেব?
আচ্ছা দাও। তবে তোমার সঙ্গে একটু কথা বলে নেই। তোমার নাম কী?