আক্কাদ বলল–রিবিকা! আজ দোলের রাত! আমি যৌন-বিহারের জন্য পাঁচটি উট চাষার ছেলেদের ভাড়া দিয়েছি। উটের দোলনে রতিমোচন আনন্দদায়ক। একজন বুড়োলোকও এই রাতে বালিকাদের দিয়ে গা লেহন করায়। ওই দ্যাখো…
একটি চালার নিচে দৃশ্যটি দেখা গেল। এক বৃদ্ধকে দুটি নগ্ন নারী চাঁদের ছায়ায় লেহন করে চলেছে। সমস্ত বুক এবং যাবৎ অঙ্গ লালায় মথিত হচ্ছে। বুকের পাঁজর দ্রুত প্রকম্পিত হচ্ছে কামনাতাড়িত বাতাসে। শিঙা বেজে উঠল মন্দির চাতালে। বৃদ্ধের মুখ দিয়ে রক্ত উথলে এসে গলা ভিজে যাচ্ছে। বুড়োটি রোগগ্রস্ত। এই রোগ ছোঁয়াচে–অথচ দুটি তরুণী বধূ তাকে লেহন করছে। মৃত্যু এবং যৌনতা এত ঘনিষ্ঠ যে সহ্য হয় না। কাম এবং পুনর্জীবন তো ইস্তারের উপাসনা মাত্র। ফসলের জন্ম আর মৃত্যু আর জন্মই জীবন।
আঙুল তুলে দেখিয়ে আক্কাদ রিবিকাকে বলল–এসো! রিবিকা বলল–তুমি আমার পিতা। ক্ষমা করো!
আক্কাদ বলল–তুমি আমার কেনা। ক্রীত যা তাই হল দাসী। তোমাতে আমার অধিকার। পালক পিতা পালিতাকে এমনি কেনে না। কুঁজের এদিকে মাথা রাখো।
কবরের দিকে মাথা রেখে রিবিক মৃত্যু আর যৌনতার মাঝখানে ছটফট করে ক্রমাগত একটি অন্ধকার স্রোতে তলিয়ে যেতে লাগল। যেন ইস্তার চলেছেন পাতালে।
.
০২.
মরু-হায়েনাটার গায়ে ভোরবেলার সূর্যের আলো এসে যখন লাগল, সে তখন অরণ্যের দিকে চলে গেল। কূপ থেকে উঠে এল রিবিকা। সূর্যদেব আটনের দিকে জলভরা দুই চোখ মেলে চাইলে সে। আমারনার বণিক নমরুর স্তোত্রোচ্চারণ মনে পড়ছিল তার।
‘দুনিয়ার সকল কিছুর একমাত্র স্রষ্টা তুমি,
যা কিছুর অস্তিত্ব চোখে পড়ে এবং পড়ে না,
সমস্তই একা তুমি সৃষ্টি করেছ;
তোমার চোখের ভিতর থেকে যাবৎ মানুষ
বেরিয়ে এসেছে। তোমার মুখ থেকে
দেবতাগণ অস্তিত্ব লাভ করেছেন;
দেবতাদের মধ্যে তুমিই রাজা ॥”
[মিশরীয় প্রাচীন কবিতা]
মহাপৃথিবীর আকাশে তুমি কোথাও সামাশ, কোথাও-বা তুমি আটন অথবা আমন। তুমিই আমেন। ঈশ্বর। অথচ তোমার এই আকাশ অবধিহারা–সবখানে তুমি রয়েছ। রিবিকা বিড়বিড় করে বলল–নারীর কতটুকু লজ্জা পাওয়া উচিত হে দেবতা! মরুপথ দিয়ে রথ এবং অশ্ব পূর্বে পশ্চিমে ছোটাছুটি করছে–কখনও-বা নেমে আসছে উত্তরের পর্বতগাত্র বেয়ে। কারা এরা? কাউকে আমি চিনি না। কে শত্র কে মিত্র আমি জানি না। শুধু জানি আমার লজ্জায় পৃথিবী লজ্জা পায় না–পৃথিবী মানে ওই আকাশ, ওই পাহাড়, সমুদ্র, লাল দরিয়া, নীল নদী, আকাশচুম্বী পিরামিড, অথবা আলোকোজ্জ্বল নিনিভে নগরী, বাবিলের স্বর্গের সিঁড়ি, কেউ লজ্জিত হয় না–ম্লান হয় না দেবতা সামাশ। হা আমীন, হা আমীন, যুদ্ধশেষে যে জেতে, যুদ্ধের পাওনা এই নারী তার হয়। আমি কারো নই, আমার মূল্য মাত্র তিনটি পশুলোমের সমান।
আমারনার সূর্যমন্দিরে আমি ছিলাম সকাউৎসর্গীকৃত নারী। হা দেবতা, তুমিই আমার বর। তামুজদেব নয়, তুমি। দেবদাসী রিবিকাকে কে তোমার দাসী করেছিল মনে আছে? একজন সম্পত্তিশালী পুরুত! নমরু নামেমাত্র বণিক–আসলে সে ভূপতি। ঘরে অনেকগুলি বউ। আমি ছিলাম তোমার ভোগ্যা–হে দেবতা! অথচ তোমার নামমাত্র। মন্দিরে রেখে নমরুই আমাকে ভোগ করত। মানুষ দেবতার নামে যা দেয়, তা আসলে নিজেরই জন্য দখলে রাখে। দেবতার ছুতা না দিলে ক্রীতদাসী হালাল হয় না–অধিকারেও থাকে না। নারী ‘তাহলীল’ হয় আমনদেবের মন্দিরে, শুদ্ধ হয়। আক্কাদের এটো মাল দেবতাকে দিয়ে শুদ্ধ করিয়ে নিয়েছিল নমরু।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নরম আলো-ঝরানো সূর্যের দিকে ফের চোখ তুলল রিবিকা। মরুপথ অশ্বের ক্ষুরের উৎক্ষিপ্ত ধূলায় একটা সমাচ্ছন্ন মেঘের মত পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে। তারই আড়াল ধরে অরণ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে রিবিকা। তার আর চলবার শক্তি নাই। অথচ তার থেমে পড়ার মত কোন ছায়া সে দেখতে পাচ্ছে না। এইভাবে একলা পথ হেঁটেছিলেন মহাপিতা আব্রাহাম।
চন্দ্রকলাকৃতি ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্ব দিকের অসুর জাতি অতীতে পুনঃ পুনঃ যে বীভৎস আক্রমণ করে মিশর থেকে ইহুদের পূর্বযুগের মোসির উম্মতদের টেনে এনে তাদের নগরগুলিতে বন্দী করেছিল–সে এক ভয়াবহ আতঙ্কের ইতিহাস; আজও সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে। অসুররা কতবার যে মিশর আক্রমণ করেছে তার সঠিক হিসেব করা হয়নি। এরা পার্বত্য হিত্তীয়দের মতই। দুর্ধর্ষ। মিশরও কম যায়নি। প্রতি-আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু মোসির মত ইহুদও শান্তি চান। তাঁর অভিযাত্রা অবশিষ্টদের নিয়ে, যারা অসুরদের হাতে এখনও বন্দী এবং যারা আজও মিশরের ক্রীতদাস মাত্র। মোসির অসম্পূর্ণ কাজ তিনি সম্পন্ন করতে চান। তিনিও আব্রাহামের মত দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত থেকে অর্ধগোলাকৃতি পথে দক্ষিণ-পশ্চিম কিনারা পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেন।
এই পথে কাঠের তৈরি তেতলা সাঁজোয়া গাড়ি গেছে। বন্দীদের বহন করে নিয়ে গেছে অসুররা। নিনিভে নগরীর দিকে চলে গেছে সৈন্যবাহিনী, রথ আর পদাতিক। অশ্ববাহিনীর পদচিহ্ন পড়েছে পথে। এই দৃশ্য কত পুরনো, যুগযুগান্তর একই দৃশ্যের অবতারণা করছে নগরনির্মাতা মানুষ–কেন করছে। কিছুই বোঝা যায় না।
রিবিকা পথের দিকে চেয়ে আঁতকে উঠল। তার হৃদয় স্তব্ধ হয়ে গেল।
সারি সারি খুঁটা পোঁতা–মানুষের মুণ্ডুহীন ধড় এবং কোথাও শুধুমাত্র গুচ্ছবাঁধা ছিন্ন মুণ্ড ঝুলছে। রক্ত টুপিয়ে পড়ছে বালির উপর লাশ পচে গলে পড়ছে, মরুশকুন আর শৃগাল খুঁটিগুলিকে ঘিরে গোল বৃত্ত রচনা করেছে, রিবিকা শৃগালগুলিকে হায়েনা ভেবে শিউরে ওঠে। পশুদের জিহ্বা লাল আর রক্তমাখা। শকুনের চঞ্চতে মানুষের হাড় আর পচা মাংস ধরা। সবই যেন মরুপথের চিরন্তন। দৃশ্য। এ-দৃশ্য কিন্তু রিবিকা এই প্রথম দেখল। অসুররা চিরদিন এভাবেই পথ অলংকৃত করে মৃতদেহ সাজিয়ে। অধিকাংশই পুরুষদেহ। আক্রান্ত জাতির পুরুষ। ধ্বংস করা একটা যুদ্ধনীতি। পুরুষকে শেকল পরিয়ে সাঁজোয়ায় তোলা বীরত্বের নমুনা। বন্দী করে কৃষিজমিতে চাষে জোড়া, পাথর কাটার কাজে নিয়োগ করা সবই যুদ্ধের উদ্দেশ্য। সুন্দরী মেয়েদের পুরুষহীন করা এবং ধর্ষণ করা এক ধরনের বিক্রম। মেয়েরাও শ্রমিক হয় দ্রাক্ষাক্ষেত্রগুলিতে।