ইহুদ বলেন, তাঁকে দেখা যায় না। তিনি অদৃশ্য। তিনি সংকেতকারী। তাঁর উদ্দেশে নিশানমাসে ঢেরা-চিহ্ন আঁকতে হয় ঘরের দেওয়ালে। এই চিহকরণের ক্রিয়াপথ হল নিস্তার বা স্বস্তিকা। যারা চিহ্ন আঁকে তারা যবহের লোক। বান্দা। যবহের দাস কখনও ফেরাউনের দাস হতে পারে না। যবহ বলেন–আমি কে। এই প্রশ্ন করো না। আমি যা আমি তাই। আমার চিহ্ন যারা আঁকে তাদের আমি রক্ষা করি। বন্যা এবং খরার হাত থেকে নিস্তারীদের বাঁচাই। শিলা ও গন্ধক বৃষ্টি তাদের মাথার উপর হতে দিই না । উত্তরের পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে ফেলে তাদের হত্যা করি না। মরুভূমির তপ্ত হাওয়া ছড়িয়ে বালিঝড় দিয়ে ফসল এবং প্রাণ নষ্ট করি না। ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত করি না আমার উপাস্যদের। মরুদস্যুর আক্রমণ থেকে তাদের রক্ষা করি। আমি তোমাদের মুক্ত করি।
কিন্তু মহাপ্লাবনের কথা মনে আছে? আমি শুধুমাত্র নোহ এবং তার নিজের লোকেদের ত্রাণ করেছিলাম। কিস্তি (নৌকা) বানানোর বুদ্ধি আমি নোহকে দিয়েছিলাম। আমি বুদ্ধি এবং জ্ঞান দান করি। তোমার শত্রুদের জন্য বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, মরুলু, গন্ধক বৃষ্টি ঘটাই। ফেরাউনের ধ্বংসের জন্য এইসব দুর্যোগ সৃষ্টি করি। ভয় পেও না–কারণ নোহ ভয় পায়নি। নিস্তার-পর্বে ঢেরা-চিহ্ন আঁকো–আমাকে স্মরণ করো। তোমাদের গুণ-চিহ্নিত গৃহ আমি রক্ষা করব। আমি গন্ধক বৃষ্টির হাত থেকে আব্রাহামকে বাঁচিয়েছিলাম। বন্যার হাত থেকে নোহকে রক্ষা করেছি। আমি মোসিকে চূণ অবস্থায় তার মায়ের পেটে লালন করেছি। এমন ব্যবস্থা করেছিলাম যে, ফেরাউন বুঝতে পারেনি মোসির মা গর্ভবতী। গর্ভাবস্থার সমস্ত লক্ষণ আমি গোপন রেখেছিলাম। সেই স্ত্রীলোকের তলপেট এমনভাবে নির্মিত ছিল যে, মোসি যে রয়েছে তা বোঝার উপায় ছিল না। পেট ফোলেনি, স্বাভাবিক ছিল। নিয়মের এই বৈকল্য আমার ইচ্ছাধীন। নইলে সেই সময় ফেরাউনের নির্দেশ ছিল মোসির উম্মতদের যত স্ত্রীলোক গর্ভবতী হয়েছে, তাদের হত্যা করা হোক। আমি গোপন করতে পারি এবং প্রকাশ করতেও পারি। আমি ওই শিশুকে আগুনের ভিতর বাঁচিয়ে রেখেছিলাম।
যখন ফেরাউনের সেপাই শিশুহত্যার জন্য প্রবেশ করল, আমি উনুনের ভিতর মোসিকে ঠেলে দিলাম। আগুন তখন নিবে গিয়েছিল। আমারই নির্দেশে আগুন নেবে এবং প্রজ্বলিত হয়। পাহাড়ে যে আগুন জ্বলে ওঠে–এ-সবই সেই সংকেত মাত্র। সেপাই সর্বত্র শিশু মোসিকে খুঁজেছে তন্নতন্ন করে, পায়নি। আমি তাকে উনুনের ভিতর রেখেছিলাম। উনুনে যে শিশু থাকতে পারে একথা শিশুর মা অবধি বিশ্বাস করেনি। কারণ আমিই তাকে গড়িয়ে দিই।
রিবিকা, তোমার মত সুন্দরী তন্বীকে আমিই কুপের ভিতর গড়িয়ে ফেলেছি, তোমাকে আমি কূপের অন্তরালে গোপন করেছি। জলকে হিংস্র করে তোলার বুদ্ধি আমিই তোমাকে দিয়েছি।
মোসি যখন তার দলবল নিয়ে লাল দরিয়া (লোহিত সাগর) পার হচ্ছেন তিনি তাঁর হাতের লাঠিকে ইশারা করেন, উত্তাল জলের উপর আঘাত করতেই জল দু’ভাগ হয়ে পথ সৃষ্টি হয়। সেই পথের উপর একখানা পাথর পড়ে ছিল, যবহ মোসিকে নির্দেশ করেন, আঘাত করো। মোসি তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে পাথরের উপর আঘাত করেন, পাথর দু’ভাগ হয়। যবহ মোসিকে এই লাঠি দান করেছেন। এই লাঠি দিয়ে তিনি মেষ চরান। মেষ যেমন লাঠির নির্দেশে একমুখে প্রবাহিত হয়, যবহ তাঁর উপাস্যদের সেইভাবে একত্রিত করেন, একাভিমুখী করেন।
ইহুদের হাতেও অনুরূপ একখানি লাঠি আছে। তিনি সেটি মাথার উপর ঘুরিয়ে বলেছিলেন–পাথর দু’ভাগ হলে দেখা গেল একটি ঘাস ফড়িং একটি ঘাস মুখে করে সমুদ্রের তলায় পাথরের ভিতর বেঁচে আছে। যবহ তাঁকে ঘাস যোগাচ্ছেন। এইভাবে তিনি গোপন করতে পারেন। রক্ষা করতে পারেন।
অথচ এলিফেনটাইনের ঢেরা-চিহ্নিত সমস্ত গৃহ এবং দুর্গটি মিশরীয়রা বেছে বেছে জ্বালিয়ে দিয়েছে। যবহ প্রেরিত মৃত্যুদূত ইহুদীদের রক্ষা করেনি। স্বপ্নদর্শী ইহুদ বলেছিলেন–সাত বছর দুর্ভিক্ষ হয়েছে, সাত বছর নীল নদীতে জলোচ্ছ্বাস। হল না–এ-সবই যবহের নির্দেশ–মিশরীয়রা দুর্বল হয়েছে এবার আমরা। কনানের দিকে চলে যেতে পারব। তাই সবাই চিহ্ন এঁকেছিল। নিস্তার পর্ব পালন করছিল। এই সময় অগ্নিসংযোগ করল মিশরীয়রা বাইরের শত্রু আক্রমণ করল ফের মিশরকে। লুঠ, হত্যা, ধর্ষণ চলতে লাগল। সবই কি যবহের নির্দেশ? আগুনের হাত থেকে মোসি বেঁচেছিলেন কিন্তু রিবিকাদের। কত প্রাণ চলে গেল! যবহ তাঁর বান্দাদের এমন শাস্তি দিলেন কেন?
রিবিকা কূপের তলায় আর্তনাদ করে উঠল–ঘাসফড়িঙের মুখে ঘাস জোগাও জানি, কিন্তু আমার বস্ত্র কেড়ে নাও। দেবী ইস্তার তো নাঙা থাকে। মহাত্মা ইহুদ!
যদি আমরা ঢেরা না আঁকতাম, আমাদের অনেকগুলি গৃহ বেঁচে যেত। চলার পথে মোসিকে যবহ যে লীলা প্রত্যক্ষ করালেন ওই পাথর দু’ভাগ করে, তার মহিমা যাই হোক, দেবী যে নগ্ন থাকে, এ তো মিথ্যা নয়। নগ্নতাই এখন বাস্তব, ধর্ষণের ফলে ছিন্ন রক্তাক্ত যৌনাঙ্গ বাস্তব, দু’পা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়া বাস্তব, পথের উপর বিচ্ছিন্ন মস্তক, ওপড়ানো চোখ বাস্তব, উটের পিঠে চড়িয়ে বালিকাকে যৌনপ্রহারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলানো বাস্তব–মনে পড়ে। সবই মনে পড়ে। এবং উপরে প্রহরারত মৃত্যু অবাস্তব নয়।