রিবিকা পারল না। সে তার আপন মূর্তির ওপর মাথা কুটতে লাগল। সে একা। স্বৰ্গ কি মানুষকে এরকম একা করে দেয়? চরম এক নিঃসঙ্গতা ছাড়া তার কিছু নেই।
কিন্তু সেই আগামীর প্রত্যুষ আর এল না। সূর্যোদয় হওয়ার আগেই হেরার কাজ চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল। রাত্রির গভীরে তাঁবুর সৈন্যরা এসে হেরার আঙুল কর্তন করে স্বর্গের মেঝেয় ফেলে রেখে চলে গেল। মেঝেয় সর্বাত্মক আর্তনাদ করে গড়াতে থাকল হেরার দেহ। হেরার এই ভয়াবহ আর্তস্বর রাত্রির আকাশকে বিদীর্ণ করতে থাকল।
রিবিকা ভেবেছিল, সৈন্যরা তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু তাকে তারা স্পর্শও করল না। একজন কেবল বলল–পবিত্র নারী অশুচি হয়েছে, ওকে স্পর্শ করা পাপ। ওকে শুদ্ধ করার লোক নেই।
নগর ধ্বংসের কাজ শুরু হল। ইহুদের অত বিশাল সৈন্যবাহিনী কোথা থেকে এল কেউ জানে না। সাদইদের স্বল্পসংখ্যক সেনার উপর সেই রাত্রেই অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাদইদ বুঝতেই পারেনি, ইহুদের ধর্ম কতদূর প্রসারিত হয়েছে। তলে তলে কতবড় সংগঠন গড়েছেন তিনি। আসলে ইহুদের সৈন্য শুধু নয়, সাগর-জাতি কনানকে আক্রমণ করল সেই রাতে। যুদ্ধ বাধল।
মিশালের নৌকায় একলা শুয়ে ছিল সাদইদ। একজন জোয়ান সমুদ্রের কিনারে অশ্বের পিঠ থেকে নামল। দিনারের মত আকৃতি। সে ঝুঁকে পড়ল নৌকার কাছে। দড়ি খুলে দিল। স্বপ্নগ্ৰস্ত গভীর নিদ্রামগ্ন সাদইদ ভেসে গেল।
.
সমুদ্র তার হৃদয়ে পরম সমাদরে সাদইদকে টেনে নিল। নৌকা তাকে তুলল, ফেলল। এই দৃশ্যের তরঙ্গের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল। এই দৃশ্যের কোন সাক্ষী রইল না। চাঁদের কিরণ ঝিলমিল করতে থাকল কেবল।
কনান থেকে আবার একটি প্রবাহ চলেছে জেরুজালেমের দিকে। বন্দর নগরীগুলি অতিক্রম করছে সেই স্রোত। কিছু স্রোত ছড়িয়ে পড়েছে মরুভূমির বুকে। মানুষের এই বিপুল প্রবাহ থামতেই চাইছে না। মহাত্মা ইহুদ এদের পথ-নির্দেশ করছেন।
ইহুদ বললেন–মানুষ আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, তাদের আবার গুছিয়ে তুলতে হবে। জেরুজালেমের বুকে হবে শেষ যুদ্ধ। সেখানেই গড়ে তুলতে হবে ইয়াহোর মন্দির। ঈশ্বর প্রত্যাদেশ করেছেন, সাদইদের স্বর্গ ছিল তাঁরই স্বর্গের মত সুন্দর। তাই ইয়াহো সাদইদের স্বর্গের সমস্ত আকৃতি নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন। স্বয়ং সাদইদ কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না।
একজন বৃদ্ধা হাহাকার করে কেঁদে বলল–লোটা ছিল সাদইদের বন্ধু!
ইহুদ বললেন–সাদইদ জন্মেছিল এক দ্বীপে। সাদইদ প্রসব হওয়ার পর তার মাকে মৃত্যুর দূত হত্যা করেন, মৃত্যুর দূত মাকে হত্যা করার মুহূর্তে কেঁদে ফেলেছিলেন। সাদইদের মৃত্যু যখন হয়, মৃত্যুর দূত আজরাইল ছাড়া তার কাছে। তখন কেউ ছিল না। এই মৃত্যুর নিঃসঙ্গতা কী ভয়াবহ ছিল ওহে আকাশের মালিক ইয়াহো! আজরাইল কত প্রাণ হত্যা করেছেন, কিন্তু কেঁদেছেন মাত্র দু’বার। সাদইদের জন্মের মুহূর্তে এবং মৃত্যুর সময়। কারণ সে স্বর্গে প্রবেশ করতে পারেনি।
মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়ে আবার চলতে শুরু করে জনস্রোত। একটি উঠের পিঠে আশ্রয় পেয়েছে রিবিকা। উটের রশি ধরে মাথা নিচু করে চলেছে হেরা।
রিবিকা প্রশ্ন করল–তুমি কেন ওভাবে চলেছ হেরা! কোথায় যাবে?
হেরা বলল–আরো একটি নগর নির্মাণের দিকে চলেছি আমরা! এ পথ স্বর্গের দিকে চলেছে রিবিকা।
রিবিকা পিছন ফিরে চেয়ে সজোরে আতশব্দে চেঁচিয়ে উঠল–কিন্তু সারগন কোথা হেরা! কোথায় তাকে রেখে এলে!
হেরা কোন জবাব দিতে পারল না। ঘাড় নিচু করে এগিয়ে যেতে থাকল। হঠাৎ রিবিকা শুধলো–তোমার যে আঙুল নেই হেরা!
হেরা বলল আমার কিছুই নেই। কিন্তু আমি নিনিভে নির্মাণ করেছিলাম। আমি সাদইদের স্বর্গ গড়েছিলাম। রিবিকা! এই কথা মানুষকে বলবার জন্য আমি তোমার সঙ্গে চলেছি। শুধু এক কষ্ট আর বিস্ময় আমার সম্বল।
–আমার যে কেউ রইল না হেরা!
–আমি রইলাম।
–কিন্তু আমাদের যে কেউ আর চায় না স্থপতি। মহাত্মা ইহুদ আর আমায় চিনতে পারেন না। আমরা যে পাপ করেছি।
হেরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–পাপ!
শুধু এইটুকু উচ্চারণ করেই পথের উপর দাঁড়িয়ে পড়ল হেরা। বুঝতে পারল রিবিকা আর তাকে ইহুদ হত্যা করতে পারেন। কারণ সাদইদ এখন ইতিহাস। কাহিনী-পরাণ। লোটা অমর। ভাবতে ভাবতে উট থেমে পড়ল।
জনস্রোত সামনে এগিয়ে চলেছে। হেরা আর রিবিকা অন্য এক দিগন্তের দিকে পাড়ি জমাল। আকাশে মেঘ জমল, ঝাঁপসা হয়ে এল দিগন্ত। তারাও কাহিনী হয়ে গেছে। তাদের জীবন আর অস্তিত্ব উদ্বাস্তু এই স্রোতের কাছে অনাবশ্যক। এরা তাদের আর চায় না।
দুটি নরনারী অতঃপর একটি জনশূন্য দিগন্তের দিকে চলেছে। এই উট এক জীবনবাহী জীব। তার রয়েছে এক বীর্যবান পুরুষ আর এক ঋতুমতী নারী।
মরুভূমে আবার একটি স্বর্গ তৈরি হবে। অতএব এখান থেকে ফের শুরু হল হেরা আর রিবিকার অভিযাত্রা।
পিছন থেকে বাতাস যেন বলে উঠল–আমার স্বর্গ আর কতদূর হেরা!
হেরা পিছনে চাইলে, সমুদ্র উত্তাল হয়েছে।