সাদইদ অভিভূত গলায় বলল–আপনি কে? ওই মেয়েটি কি আপনার? বৃদ্ধা বলল–আমি আর কে বাছা! তোমার দয়ায় আমরা বেঁচে আছি। ওটা আমার মেয়ে। আমি বিধবা। তোমাকে আমি কখনও যে আমার কুঁড়ে ঘরের সামনে দেখতে পাব ভাবিনি। এ যে স্বপ্ন বাবা। দাঁড়াও। তোমার স্বর্গে দেবার। জন্য একটা দানসামগ্রী রেখেছি, ভেবেছিলাম মেয়ের বিয়েতে দেব।
বিধবা ঘর থেকে এক টুকরো ধাতু মুঠোয় করে এনে সাইদের দিকে এগিয়ে ধরল।
বলল–নাও। স্বর্গ গড়ে তোল সারগন। খুব তুচ্ছ, কিন্তু হেলা করো না। আমি দিলাম। আমার আর কিছু নেই।
সাদইদ অশ্বের কাছে ফিরে এল। স্বর্গটিকেই যেন সে হাতের মুঠোয় করে ধরে এনেছে। মুহূর্তে সে তার সমস্ত অবস্থার কথা বিস্মৃত হয়েছিল। রিবিকার হাতটা আপন হাতে তুলে নিয়ে একটি তালুতে ধাতুটুকু অর্পণ করে বলল রাখো রিবিকা!
রিবিকা মুঠোয় চেপে ধরে চোখ মুদে কেঁদে ফেলল। তারপর কথা বলে ফেলল, আর সে চুপ করে থাকতে পারল না।
বলল–আমায় দুর্ভিক্ষের মুখে তাঁবুতে ফেলে দিও না সারগন। আমি বাঁচতে চাই। আমি তোমার। সাদইদ! আমাকে এভাবে কেন নিয়ে যাচ্ছ!
সাদইদ বলল–আমি তোমায় ফেলে দেব না রিবিকা। এ অশ্ব এখন উপরে উঠবে। ইয়াহো নয়। ইহুদ নয়। লোটাও নয় রিবিকা। হেরা! একমাত্র হেরা!
তাঁবুর পথ ছেড়ে অশ্ব উপত্যকার দিকে সবেগে ছুটতে শুরু করল। সাদইদ চিৎকার করে উঠল–হেরা!
রিবিকা ফুঁপিয়ে উঠল পাষাণ-বন্দী উড়ন্ত একটি জোনাকির মত, অশুর মত।
.
১২.
হেরা কেবলই রিবিকার পা দু’খানির দিকে চেয়ে ছিল কতকাল। তার শুধু সাদইদের করুণ অসহায় মুখচ্ছবি মনে পড়ত। কিছুতেই হেরা রিবিকার মুখের দিকে চোখ তুলে চাইতে পারত না। অথচ রিবিকার নগ্ন দেহ এবং মুখের অপরূপতা না দেখলে মূর্তি নির্মাণ করা যায় না। হেরা উপত্যকা নিচে স্বর্গের রাস্তা যেখান থেকে সমতল স্পর্শ করে উপরে উঠে এসেছে ঠিক সেই নিম্নভাগে লোটার অশ্বারোহী প্রস্তরমূর্তি খাড়া করেছে। সমস্ত পথ প্রস্তরশোভিত করেছে। উপত্যকায় সুসজ্জিত করেছে বৃক্ষলতাপুষ্প এবং মধুচক্রের বিন্যাস। স্বর্গের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত করেছে ঝর্নার স্রোত এবং শান্ত উদ্যানকে বেষ্টন করেছে ছবির মত স্থির জলাশয়। এখানে চিরবসন্ত বিরাজ করবে, এই তার প্রত্যাশা।
কিন্তু রিবিকাকে পাথরে উৎকীর্ণ করার উপায় তার জানা নেই। তার কেবলই। মনে হত, সে রিবিকাকে তুক করার কথা বলেছিল এজন্য যে, নিনিভার মুখশ্রী তাকে মুক্তি দিচ্ছিল না। আজ নিনিভা নষ্ট হয়ে গেছে। সে তবে রিবিকার মুখের দিকে চাইতে পারে। কিন্তু কিছুতেই সে চোখ তুলতে পারল না।
.
এইভাবে কতকাল কেটে গেছে। সে ছুটে গেছে সাদইদের কাছে। বলতে চেয়েছে–আমি পারব না সাদ। রিবিকার নগ্ন দেহ এবং মুখশ্রী দেখলে আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারব না। তোমার স্বপ্ন আমার স্পর্শে নষ্ট হবে । তোমাকে আমি নগর দিয়েছি, স্বর্গ চেও না।
সাদইদ বলেছে–আর কতকাল অপেক্ষা করব হেরা! তোমার প্রজাপতি কি উড়ে এল? আমি তোমাকে সর্বস্ব দিয়েছি, আমাকে আমার স্বর্গ উপহার দাও। মরুভূমিতে ছিলাম, একটি মেয়ের রূপ দেখে আমি একটি শিশুর জন্য স্বর্গের কল্পনা করেছি। আমি চেয়ে আছি, তুমি কবে ডাকবে!
হেরা কোন কথা না বলে তার মূর্তির কাছে ফিরে এসেছে। সে কিছুতেই আর শুরু করতে পারছে না! সে রিবিকার পা দু’খানির দিকে চেয়ে আছে। একদিন এভাবে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ হেরার ছায়া পড়ল জলাশয়ের জলে।
হেরার মাথায় বুদ্ধি খেলে ওঠে। হৃদয়ে আলোড়িত হয় ছায়া। সে একটি উচ্চ পাটাতন খাড়া করে। জলাশয়ের উপর, কিনারে বাঁকিয়ে তৈরি করে একটি গোল অর্ধচন্দ্রকলাকৃতি পাটাতন–যার উপর গিয়ে বসে থাকে সে। রিবিকা জলের তলে হেরার ছায়া দেখতে পায় একটি গাছের ছায়ায় বসে–এখানে থাম উঠেছে গৃহের। মানুষ এখানে আড়াল হতে পারে। অথচ জলাশয়ের পতিত ছায়া দেখা যায়।
রিবিকা একদিন অতঃপর পাটাতনের উপর গিয়ে বসে পড়ে। গায়ের কাপড় ফেলে দিয়ে নগ্ন হয়। ছায়ার উপর চোখ পড়ে হেরার। হেরা তার কাজ শুরু করে। হেরা ভালবেসে ফেলে একটি ছায়া। আর কিছু নয়। রিবিকা, নগ্ন রিবিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে–সে জীবনভর কোন পুরুষকেই পেল না। সে একটা ছায়ামাত্র। মরুভূমির বুকে সে ছিল। স্বর্গেও সে রয়েছে। অথচ সে মানুষ নয়।
রিবিকা আর্তনাদ করল আমায় যেতে দাও হেরা! আমাকে পাষাণে বন্দী করো না।
হেরা বলল–তুমি ছায়া মাত্র। তোমার কথার জবাব আমার জানা নেই রিবিকা! আমাকে কাজ করতে দাও।
রিবিকা চিৎকার করল–আমি যেতে চাই। আমাকে সারগনের কাছে নিয়ে চল।
–কাজ শেষ হলেই তুমি সারগনকে ফিরে পাবে রিবিকা।
–কবে শেষ হবে?
–আর দেরি নেই।
সাদইদের মনে হল, স্বর্গের সেই কক্ষে রিবিকা রয়েছে। তার কি কষ্ট হয় না?
একদিন সে ঘোড়া ছুটিয়ে উপত্যকায় ছুটে এল।
হেরা বলল–কাজ শেষ হয়ে এসেছে। এবার তুমি স্বর্গে প্রবেশ করবে।
–কবে হেরা?
–কালই সাদইদ। কাল প্রত্যুষে–সূর্যোদয়ের মুহূর্তে । সামান্য কাজ বাকি। কক্ষের নারী স্বর্গের বাইরে অশ্বের হেষা শুনে বাবার মত কেঁদে উঠল। মনে হল, এ যেন লোটার কালো ঘোড়া তাকে ডাকছে। হঠাৎ কেন তার এমন মনে হল সে জানে না। মরুভূমি সত্য ছিল না, এই স্বর্গও সত্য নয়। তার নিজেরই আকৃতি এক মরীচিকা মাত্র। সে বাস্তব নয়। তার বিবাহ বাস্তব ছিল না। সে সমুদ্রে মিশালের নৌকায় লুকিয়ে ছিল সে জীবন অবাস্তবই ছিল। তবে এখানে কেন সে রয়েছে! রিবিকার ইচ্ছে করল, সে বাইরে বেরিয়ে পড়ে।