সাদইদ এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বলল–ওকে নিতে দিন মহাত্মা ইহুদ!
–না। পাপের শস্য নেবে না। যে উদ্দেশ্যেতুমি মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছিলে, তার অহংকার আছে, সেই শস্য মুখে ভোলা পাপ সাদইদ। ইয়াহোর বান্দা শুকিয়ে মরবে, তবু নেবে না। মরুভূমিতে আমরা পরীক্ষা দিয়েছি, আজও পরীক্ষা শেষ হয়নি। তুমি যা কেড়ে নিয়েছ, সবই তোমায় ফেরত দিতে হবে। তোমাকে মানুষ বিশ্বাস করে না। তুমি নিজেকে ঈশ্বর মনে কর!
ইহুদ আর দাঁড়ালেন না। যে লোকটি ঘাড়ের বসন সামনে মেলে আঁচল পেতেছিল, সে অতঃপর ইহুদের পিছুপিছু ঘাড় নিচু করে চলে যেতে লাগল। পলকহারা সাদইদ খুব আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইল সেদিকে। দুটি চোখ তার ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে এল। এক সিক্ত বেদনার ছায়া চোখের পাতায় ভার হয়ে বসল। তার মনে হল, সবই বৃথা। এই জীবন আর বহন করা যায় না।
রাত্রির হালকা চন্দ্রকিরণে নিঃসঙ্গ সাদইদ সাদা অখের পিঠে ঘুরে বেড়ায়। দেখতে পায় যে মানুষ ক্ষুধায়, শীতে, মড়কে কাহিল, সে ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়ে আছে, তাঁবুতে বা গৃহকোণে কিংবা পথের ধূলায়, কাঁকরমেশানো কালো মাটিতে, সাদা বালিতে-ইয়াহোর নাম ধরে আর্তনাদ করছে। মনে হল, মনের কোন্ মহাবল এদের এমন করেছে! সাদইদের কষ্টের সীমা রইল না।
গভীর রাত্রিতে নৌকায় ফিরে এসে সীমাহীন অপমান তাকে বিদ্ধ করতে থাকল। দামী পাথরটার কথা তার বারবার মনে পড়ছিল। হেরার আকুলতা সে ভুলতে পারছিল না। মনে পড়ছিল, মানুষের পথে পড়ে ধুঁকতে ধুঁকতে ইয়াহোর নাম উচ্চারণ করতে করতে মরে যাওয়ার দৃশ্য। এরা তার কাছে হাত পাতবে না। পাপের শস্য গ্রহণ করবে না। তাকে তারা বিশ্বাস করে না। সে লোটার বউকে হরণ করেছে। মানুষকে সে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য উপত্যকায় স্বর্গের ভিত তৈরি করেছে!
সাদইদ রিবিকার ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে ছিল। এই সৌন্দর্য এক জমাট বধিরতা মাত্র, চেয়ে থাকলে স্বাসরোধ হয়ে যায়। রিবিকা চোখ মেললে এই রাত্রে আর সাদইদ সইতে পারবে না। সৌন্দর্যের সেই ভাষার সামনে সে দাঁড়াতে পারবে না। এমন কেন ভয় করছে,সাদইদ বুঝে পায় না। মনে হল, জীবনেও সে আর রিবিকার চোখদুটির দিকে চাইতে পারবে না। মরুভূমিতে কোনওই সৌন্দর্য ছিল না, কিন্তু এই নারী ছিল। জীবনে এমন কেন ঘটেছিল,সাদইদের জানা নেই। লোটা সাদইদকে বিশ্বাস করত, ভাবত, সাদইদ থাকতে তার কোনওই ভয় নেই, মৃত্যুও লোটাকে স্পর্শ করবে না। অথচ মৃত্যু নোটাকে স্পর্শ করেছে, সাদইদ স্পর্শ করেছে লোটার বউকে!
সাদইদ আর ভাবতে পারছিল না। স্বর্গের জন্য এই নারীর নগ্নতা জরুরি, হেরার সামনে একান্ত এই রূপ খুলে বসা দরকার। সবই সত্য! অথচ আজ আর কোন কিছুই সত্য নয়। রিবিকার গায়ের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে সাদইদ থেমে পড়ল। তার এত কষ্ট হচ্ছিল যে, বুকের ভিতরে যেন একটি মরুভূমি ঢুকে গিয়ে হাহাকার-করা ‘লু’ প্রবাহিত করছিল।
এইভাবে রাত কেটে যাচ্ছিল। সমুদ্র তোলপাড় করছিল। চাঁদ নিবে গিয়ে সমুদ্র কালো হয়ে আসছিল। চোখের সামনের জল যে জল তা আর মনে হল না। হঠাৎ এ কী! অস্পষ্ট উত্তালতার খাঁজে খাঁজে একটি কালো অশ্ব ছুটে বেড়াচ্ছে কেন? ঢেউগুলি যেন স্থির হয়ে পড়ছে মুহূর্তে, তার আড়ালে কালো ঘোড়া! সেই দৃশ্য ভেঙে আবার একই দৃশ্য তৈরি হচ্ছে।
সাদইদ চাইছিল নিচ্ছিদ্র এক অন্ধকার সমুদ্র যাতে আর দেখতে না হয়। চাঁদ শেষ হলেই যেন সমুদ্র শেষ হবে। বাইরে দূরে গাছপালার দিকে চাইল সে–কালো এলোমেলো ছায়া। অন্ধকারে এইবার সে রিবিকার গায়ে হাত দিয়ে ডাকল–চলো রিবিকা, সময় হয়েছে!
রিবিকা অন্ধকারেই উঠে বসল। নৌকা থেকে নেমে এল ওরা। কোনওই কথা বলল না। সাদইদ ভাবছিল, রিবিকা নিশ্চয়ই কিছু বলবে। নির্বাক অশ্ব অতঃপর অন্ধকারেই অগ্রসর হল। সমুদ্র রইল পিছনে, সামনে গ্রাম, তারপর ক্রমশ নদী এগিয়ে আসতে থাকল। নদী পার হল ওরা। রাত শেষ হয়ে আসছে। মরুভূমি থেকে শীত সরে গেছে। শেষরাতে শীতলতা আছে বাতাসে, আকাশের এককোণে মেঘও জমেছে গ্রামগুলির উপর। অন্ধকার ফিকে হয়েছে, মেঘটার দিকে চোখ পড়ল সাদইদের। রাত এভাবে আরো ফুরিয়ে এল।
রিবিকা তবু কোন কথা বলল না। হঠাৎ একটি কুটিরের সামনে এসে অদ্ভুত একটা গানের কলি শুনে থেমে পড়ল সাদইদ। একটি বৃদ্ধা আপনমনে নিশ্চয়ই বলছে না, কারুকে উদ্দেশ করেই বলছে কোন কাহিনী। ফাঁকে ফাঁকে দু’একটি কলি গেয়ে উঠছে।
সারগন এগিয়ে চলেছে সাদা অশ্বে। পিছনে তেড়ে আসছে মৃত্যুর দেবদূত আজরাইল। সারগন বুঝতেই পারছে না। সারগন বুঝতেই বা পারবে কেন? ইয়াহো যাকে পাঠায়, সেই মরণ, তাকে তো দেখা যায় না। যদি সারগন তার আপন হাতে গড়া স্বর্গে পৌঁছে যেতে পারে, মরণের সাধ্য নেই তাকে ছোঁয়ার। সারগন দ্রুত অশ্ব তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে।
অশ্ব থেকে নেমে পড়ল সাদইদ। শুনতে পেল এবার একটা সুর :
‘সারগন যায় উপত্যকার সড়কে–
মানুষ মরে খিদের জ্বালায় মড়কে।
তবু সারগন থামে না, মধুর দেশে দুধের দেশে;
সারগন যায় সিঁড়ির শেষে উপরে, বাতাসে–
সারগন যায় আকাশে, দুধের পথ, তারার আলোর উপরে,
তার গন্ধ বাতাসে, তার শব্দ আকাশে, শহরে ॥’
সাদইদ কুটিরের সামনে এসে দাঁড়াতেই গান থেমে গেল। বৃদ্ধা কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। অবাক হয়ে চেয়ে রইল সৈনিকের মত দৃপ্ত বলিষ্ঠ সাদইদের দিকে। সাদইদের আজকের পোশাক ছিল সৈনিকেরই মত।