–এ-সবই ঘটনা রিবিকা! প্রশ্ন করো না। এভাবে চিন্তা করা পাপ। নারী কখনও এভাবে চিন্তা করে না।
–তবে আমায় যেতে দাও। –বলে রিবিকা সমুদ্রে ঝাঁপ দেবার জন্য এগিয়ে যায়। সাদইদ বলে, স্বর্গ ওদিকে নয় রিবিকা! বলেই সে রিবিকার দেহ হাত ধরে টেনে নেয় নিজের দিকে। তারপর অবাক হয়ে ভাবে, স্বর্গ তবে কোথায়! একটু আগেই তো সে নিজে জ্যোৎস্না-পুলকিত রাত্রির তলায় উত্তাল সমুদ্রের নিচে একটি নদীতীরে অমরাবতীর সেই কক্ষ কল্পনা করছিল।
রিবিকা সাদইদের বাধা ঠেলে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে চায়–তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় সাদইদের বলপ্রয়োগে। সাদইদ অতঃপর রিবিকাকে একপ্রকার জোর করেই সম্ভোগ করতে থাকে। রিবিকা বাধা দিয়েও ঠেকাতে পারে না। অবশেষে রিবিকা মেনে নেয় এবং ভাবে, এই পৃথিবীকে তার আর কোন প্রশ্ন করার নেই। তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। এই বলপ্রয়োগই বীজ। এরই নাম মাটি আর উদ্ভিদ। দেবী ইস্তারের জন্মকথা, তার মৃত্যু, তার প্রেম আর নগ্নতা কখনও শেষ হবে না। সে স্বর্গে গেলেও নগ্নই থাকবে। তবে, এই পুরুষকে যেন সে এইভাবে অন্য কোন জীবনে বুকের ভিতর পায়–ঈশ্বর যেন এই ব্যবস্থা করতে পারেন!
দাঙ্গাবিধ্বস্ত কনান। দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশ। পশুদের মড়ক লেগেছে। বন্যায় বাঁধ ভেঙে ভেসে গেছে শস্যক্ষেত। বন্যার পর মড়ক। তারপর দুর্ভিক্ষ। তীব্র শীত হানা দিল ঘরে ঘরে। শীতেও মানুষ মরতে লাগল। সবচেয়ে বেশি মারা গেল তাঁবুর লোক। আগুন জ্বালবার, রাতে গা গরম করে কোনপ্রকারে বাঁচার তাগিদে তাঁবুর মানুষ চাষী-গেরস্তর আঙিনায় শুকনো কাঠ চুরি করতে এসে ধরা পড়ল। নির্মম বিচারে চোরের হাত কেটে দিল জনগণ। সেই কাটা হাত দেখিয়ে জনে জনে সে বলে বেড়াতে লাগল–সে একজন দামাদ। জামাইবাবু। চার ঘরের বর, দেখে রাখুন, কী হেনস্থা করেছে।
সাদইদ হেরাকে বলল–সমস্ত উদ্বৃত্ত, যা দিয়ে নগর এবং মূর্তি তৈরি হয়, সব বিলি করে দেব। যত মূল্যবান ধাতু, দামী পাথর বাইরে থেকে আনা হয়েছিল, সব বিক্রি করে বস্ত্র কিনে নেব। সবই বিলি করতে হবে।
হেরা বলল–সব হাতে তুলে দেবার পরও দেখবে, কত মানুষ মরে গেছে।
–তবু যতদূর বাঁচাতে পারি। স্বর্গ গড়ার কাজ স্থগিত রেখে দাও হেরা!
হেরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–মহাত্মা ইহুদ বলেছেন, এই বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মড়ক, মহাশীত সবই স্বর্গ গড়তে চাওয়ার পাপ । তুমিই মানুষের দুঃখের জন্য দায়ী। এতকাল দেবতার দোষ দেওয়া হত, এবার মানুষ তোমাকে দুষছে! তাছাড়া..
–তাছাড়া কী?
–এত কষ্ট, তবু মানুষ দাঙ্গার পর গুমখুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে অবিরাম!
–মহাত্মা ইহুদ কী করছেন হেরা!
–লাঠির শাসন মানুষ শুনছে না সাদইদ। ইহুদ বলছেন, স্বর্গ গড়া বন্ধ হলে তবে মানুষ শাপ এবং পাপমুক্ত হবে।
–স্বর্গ সম্ভব নয় হেরা। তুমি ফিরে যাও।
–আমি ফিরে যাব?
–হ্যাঁ হেরা! আমি তোমায় বিদায় দিচ্ছি!
দামী পাথরগুলি বিক্রি করতে শুরু করল সাদইদ। চোখের সামনে এই দৃশ্য সহ্য করছে পারছিল না হেরা। বণিকরা সব বস্ত্রের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়ে উট এবং অশ্বের পিঠ বোঝাই করে ফিরে যাচ্ছিল। সেই দৃশ্য সমুদ্রের উপর ভাসমান নৌকা থেকে রিবিকাও লক্ষ্য করছিল। সাদইদ একটা উচ্চ শিলাসনে দাঁড়িয়ে খাদ্য আর কাপড় বিলি করছিল। সে দৃশ্য রিবিকার দৃষ্টিসীমার বাইরেই ছিল।
চোখের সামনে দিয়ে বহুকষ্টে সংগৃহীত পাথরগুলি চলে যাচ্ছিল। নির্মাণের কাজে এতবড় আত্মঘাত সহ্য করা হেরার পক্ষে খুবই প্রাণবিদারী ঘটনা। তার সুন্দরের অনুভূতির স্তরে স্তরে আঘাত পড়ছিল বারবার। হঠাৎ সে লক্ষ্য করল, সবচেয়ে উজ্জ্বল পাথরখণ্ড, যা অফুরন্ত বাসন্তী আলো বিকিরণ করে, যা দিয়ে সে অমরাবতীর নির্দিষ্ট কক্ষে চিরবসন্ত বিরাজ করবে এমন স্ফুটিত রঙিন শুভ্রতার সঙ্গে চাপা বাসন্তী আভা ছড়াবে বলে পাথরটি প্রাণান্ত চেষ্টায় জোগাড় করেছিল, সেই পাথরটিও বেচে দিচ্ছে সাদইদ।
দ্রুত ছুটে গিয়ে হেরা বণিকটির সামনে দাঁড়িয়ে সাদইদের দু’হাত চেপে ধরে বলল–দিও না। এভাবে দিও না সাদ। তোমার স্বর্গে তাহলে কখনও প্রজাপতি উড়ে আসবে না।
পাগলের মত ককিয়ে উঠল হেরা। বণিকটি আশ্চর্য হয়ে গেল, কিঞ্চিৎ থতমত করে বলল–পাথরটা দামী নিশ্চয়। দামও আমি দেব। গরম গরম ভাল পোশাক আর খাঁটি মদ আমার কাছে আছে।
হেরা বলল–আপনি অনেককিছুই বোঝাই করেছেন–এই পাথরটা আর চাইবেন না।
বণিকটি বলল–দাম আমি উপযুক্তই দিতাম, আমি উটের পিঠ খালি করে দিয়ে যেতাম। চারদিকে আকাল চলছে, ভেবে দেখুন!
সাদইদ হেরার ভয়ানক অস্থিরতা দেখে বলল–ঠিক আছে সওদাগর, আপনি বরং এখন চলে যান, পরে দেখা যাবে’খন।
–না। পরে নয়। কখনওই নয়। আপনি আসবেন না। চলে যান। একবারে চলে যান!
হেরা যেন আর্তনাদ করে উঠল। বলল–এভাবে আমায় তুমি বাতিল করে দিও না সাদইদ!
এই সময় চোখে পড়ল আর এক দৃশ্য। কাঠের উচ্চ চারপায়ার উপর দাঁড়িয়ে সাদইদের নির্দেশে যে মধ্যবয়স্ক শান্ত মেজাজের স্বাস্থ্যবান কর্মীটি কাপড় এবং গম বিতরণ করছিল তার সামনে সহসা কখন লাঠি হাতে এসে দাঁড়িয়েছেন ইহুদ। লাঠির অগ্রভাগ দিয়ে ঠেলা দিলেন গম মাপার পাত্রটিতে, যে দুঃখী তাঁবুর বাসিন্দা আঁচল পেতেছিল, সে সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে আঁচল গুটিয়ে নিল। গমগুলি মাটির উপর পড়ে গেল।