রিবিকার মায়ের মুখের ভাষা ছিল অন্যধারা। পরিবারের পাঁচজন নাকি বুঝতেই পারত না। কে জানে কী ছিল–মাকে তো রিবিকার তেমন মনেই নেই। ভাষাভেদ মানুষকে বিভিন্ন করে, খাদ্যাভ্যাস আলাদা করে দেয়–সর্বোপরি ধর্ম কখনই এক হতে দেয় না। অথচ রিবিকার বাবা ছিল মহাপিতা নোহের বংশধর। নোহ কি যাযাবর ছিলেন না? নোহকে কেন যে সবাই চাষী মনে করে? চাষী বটে, জেলেও বটে, মিস্ত্রীও বটে। তিনি নৌকার কারিগর, চাষের উদগাতা, বীজ ও জীবের পালক। অথচ তিনিও মহাপুরুষ পুণ্যশ্লোক আব্রাহামেরই পূর্বপুরুষ।
তা সত্ত্বেও বিভেদ কম নয়। আব্রাহামীরা একদা যখন বাবিলনের পতনের পর ঈশ্বর যবহের অভিশাপে ভাষাভেদ হল বারোটি গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে গেল মরুনগরী আর গ্রামগুলি এবং মরুছাউনিগুলিতে, নোহ তাঁর নৌকায় সকল গোষ্ঠীর বীজ ও জীবকে স্থান দিয়েছিলেন-তিনি ভাষাভেদ গণ্য করেননি–যাযাবর কি চাষী, ভেদাভেদ করেননি।
রিবিকার বাবা যদি মাকে পত্নীরূপে বিবাহ করতেন, তাহলে বোধহয় রিবিকা এভাবে বিচ্ছিন্ন হত না। আক্কাদ মরুবণিক যাযাবর সালেহর কউম। ঠাকুমা একবার ভেবেও দেখলেন না কার হাতে পড়ছে মেয়েটি! যেখানে যাচ্ছে। সেখানকার অবস্থা কীরকম। তিনটি মেষ আর মেয়ে কি সমান? কনানীয়দের গণিতের ভাষা কি এই ধারা? মন্দিরের দেবীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে রিবিকা আপন মনে ফুঁপিয়ে উঠল। চতুর্থ প্রস্থ কাপড় খণ্ড খুলে ফেলেছে। পুরোহিত।
উটের চিহ্ন নিয়ে বিবাদ। আসলে আক্কাদীয়দের কেউ চায় না। মন্দিরে উটের ঠাই দিতে গভীর কুঠা-পুরোহিতরা চরম অসন্তোষে প্রতি বছর দোলের রাতে বিবাদ বাধায়। তারা চায় আক্কাদীয়দের উচ্ছেদ করতে। কিন্তু আক্কাদ অনেক চাষী পরিবারের লোম, মদ আর শুঁটকি মাছ দাদন দিয়ে মাথা খরিদ করে রেখেছে। আক্কাদের এই উন্নতি পুরোহিতরা সহ্য করতে পারে না।
সালেহ মরুপথে ঘুরে মরেছেন। উটের মাংস আর তৃষ্ণার জল দিয়ে তাঁর বাহক মানুষের জীবন রক্ষা করেছে–তাঁর দলকে নিয়ে ঘুরেছেন তিনি উষর মরু, নীল বনানী, সবুজ উপত্যকার চন্দ্রকলাকৃতি পথে। তাঁর পূর্বপুরুষ আব্রাহামের মত তাঁরও চোখে ছিল একটি পবিত্র দেশের স্বপ্ন, মধুদুগ্ধপ্রবাহিনী দেশের মেঘমেদুর ছায়ায় তিনি আশ্রয় এবং সমাধির স্বপ্ন দেখেছিলেন।
সালেহ পাননি। উটের কুঁজই তাঁর সমাধিক্ষেত্র। মন্দিরের সামনে থেকে রিবিকাকে আক্কাদের ভগিনী এসে জোর করে হাত ধরে টানল। আক্কাদের উটের কাছে এনে রেখে গেল। ইস্তার পুরাণে উট-উপাস্যদের বিধর্মী এবং বিদেশী বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে দেবী তাঁদেরও বাঁ হাতে গমশীর্ষ উপচার নেন। দেবী হতভাগ্যদের অমোচন করেন। অসভ্য জাতিরা সংযত থাকলে দেবী প্রসন্ন থাকেন। দেবী গমশীর্ষ চান–উট-উপাসক যেন নিজের জমি থেকে সেই ফসল উৎপাদন করে।
কিন্তু সালেহর যেখানে মরবার মত সাড়ে তিনহাত জমিই ছিল না–সেক্ষেত্রে তাঁর সংখ্যালঘু গোত্রটি জমি কোথায় পাবে–গমই বা ফলাবে কোথায়?
রিবিকাকে মন্দিরের চৌহদ্দির অনেক দূরে দাঁড়িয়ে দেবী ইস্তারের অর্চনা প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছিল, এমন সময় আক্কাদ-ভগিনী সেবা তাকে টেনে নিয়ে এল।
বলল–ওভাবে হাঁ করে দাঁড়িয়ে কী দেখছ? পোশাক-খোয়ানো নাঙা দেবী নিজেই তো বাঁচে না, তোমায় কি রাখবে গা? নবী সালেহর আশ্রয়ই আসল। পাতালে গিয়ে ভাসেন যে-দেবী, ইজ্জৎ যার নিজেরই নেই, তা ফের গমের শীষ! কথায় বলে কিসে আর কিসে–তামা আর সীসে! কোথায় সালেহ আর কোথায় ইস্তার। এসো তেতা, দাদা সেই কখন থেকে সেজে বসে আছেন ভোলায়।
উটের পিঠে দোলা চাপানো হয়েছে। সেবা বলে ভোলা। ঠেলা দিয়ে সেবা রিবিকাকে উটের পিঠে তুলে দিতেই উটটা চলতে শুরু করল।
মৃত্যবৎ জঘন্য-দর্শন কুৎসিত লম্বা মুখাকৃতি হায়েনাটা ফের ফিরে এসেছে। কূপের উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রিবিকাকে দেখছে। সঙ্গে সঙ্গে রিবিকা সতর্ক হয়। জলের তলায় সজোরে হাত এবং আঙুল নেড়ে জলকে সরব আর হিংস্র করে তোলে। জলের যেমন সুন্দর ধ্বনি আছে, ফোরাত আর হিদ্দেকলের নদীতে সুর আছে, আছে জর্দনে আর নীল নদীতে সংগীতের ধ্বনিমালা, পার্বত্য নদীগুলির গান আছে ঝিরিঝিরি, তেমনি সেই জলেই রয়েছে হিংসা। ভয়াবহ প্লাবনে সেই হিংসারই ছবি ভেসে ওঠে।
কূপের জল মায়াবী। রিবিকার প্রাণরক্ষা করেছে। ফের সেই জলকে হিংস্র করে তুলে তাই হয়েছে তার অস্ত্র। হিংসা দিয়ে হিংসা দমন করা একটা শিক্ষা বটে। কিন্তু একে দমন না বলে, বলা উচিত–হিংসা ঢাল এবং হিংসাই তরবারি। শুধু আত্মরক্ষার জন্য ইহুদের ঈশ্বর এই হিংসার পক্ষপাতী। কোমল আর মৃদু এই হিংসা আজকার এই জলের মত সত্য। একজন ক্রীতদাসের হিংসা এরকমই নরম আর মায়াবী হতে বাধ্য।
যবহের হিংসা কোমল আর মায়াবী। সীনয় পাহাড়ে তাঁর আত্মা রয়েছে। তিনি জ্বলে ওঠেন কিন্তু কখনও দাবানল ঘটান না। চোখে এই দৃশ্য দেখা যায়। হঠাৎ আকাশের তলা আর পাহাড়ের চূড়া রক্তিম হয়ে ওঠে। আগুন লাগে আকাশের গায়ে। অথচ আকাশ থেকে গন্ধক বৃষ্টি হয় না, মানুষ পুড়ে মরে না। যবহের পবিত্র চোখ থেকে আগুনের সংকেত বার হয়। যবহ পবিত্র নাম। মনে মনে তাঁকে ডাকতে হয়। তিনি বাবিলের স্বর্গ (জিগুরাত)-এর পতন হলে পিতা আব্রাহামকে ডেকে নিয়েছিলেন। মহাত্মা মোসিকে তিনি মিশর থেকে উদ্ধার করেন। যবহ এক রহস্যময় ঈশ্বর। তাঁর সংকেত আছে। জ্বলে ওঠা আছে, হিংসা আছে কোমল আর মৃদু। যবহ, কে? যবহ কেমন?