কিন্তু নির্মাণ? স্থাপত্য? মূর্তি? হেরা ভাবল, কেন সে নির্মাণ করেছিল? সে কি তবে ধ্বংসের জন্য? একটা পাগলা পাথর যেমন পাহাড় থেকে খসে পড়ে, তেমনি একটা পাথর শিশুর মাথায় মেরে থেঁতলে দেওয়াও কি একটা অদৃশ্য ক্ষমতা? যুদ্ধেরই আর একটা রূপ? দিনার যদি করে থাকে–কেন করছে? সে যুদ্ধের লাশ গুনত ছেলেবেলায় উটের পিঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, একথা বলে সাদইদ। যুদ্ধের ভিতর জন্মালে কি একটা মানুষ পাথর মারতে ভালবাসে? আকৃতি নষ্ট করা, মানুষকে পোড়ানো, মাটিতে পোঁতাও কি একটা দায়িত্ব?
ভাবতে ভাবতে হেরার মাথাটা গোলমাল হয়ে যায়। নিনি আমাকে ডাকল! নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বসন আলগা করল কী কুশ্রীভাবে! নারীর সৌন্দর্যে আছে স্বর্গের আলো, শিশুর নগ্নতা ঈশ্বরের হাসির মত পবিত্র। সাদইদ এসব বলে। হেরা ভাবল, আসলে একটি মেয়েকে তুক করা ছাড়া আর কিছুই হয় না। তার সুন্দর আকৃতি এই বিশ্বে কখনও বজায় থাকে না। নগর ধ্বংস হয়, সেও ধ্বংস হয়। তবে নির্মাণ কেন করে মানুষ? হেরা ভাবল, তুক। রিবিকাকে তুক। করব। আর কিছু নয়। একবার তাকে হৃদয়ে বিম্বিত করাই আসলে সবকিছু। সেটাই তো স্বর্গ।
সাদইদের মনে হল, সমুদ্রে জলের তলায় একটি নদী প্রবাহিত হচ্ছে। তার তীরে অমরাবতী। বাইরে মাটির উপর আর কখনও স্বর্গ গড়া যাবে না। তার সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করছিল। মৃত্যুরও আকাঙ্ক্ষা থাকে। মনে হল, মৃত্যু যেন তাকে চাইছে। মিশালের নৌকা দুলছে। অসম্ভব তীব্র জ্যোৎস্নার এ রাত। চাঁদটা রাসরি এসে পড়েছে ঘুমন্ত রিবিকার মুখে। সাদইদ ভাবল, এই ফাঁকে সে জলে নেমে পড়ে। তারপর মনে হল, রিবিকাকে সে আর বহন করতে পারছে না। এই সীমাহীন রূপের ভিতর মদ নয়, মৃত্যু রয়েছে। এমন কি কখনও কেউ ভাবে? সুন্দরের সামনে দাঁড়ালে কি এরকম হয়? মরে যেতে ইচ্ছে করে?
নারী যে সুন্দর, তার রূপ থেকে স্বর্গের আলো তৈরি হয় শিল্পীর হাতে, এই কল্পনা তার মাথায় না এলে, এই জগতে তার কোনওই দুঃখ ছিল না। একটি প্রজাপতি থেকে এই ভাবনার উদয়। সমুদ্রেই তবে তার বিসর্জন হোক। বাইরে জ্যোৎস্না, জলে, কিনারে জ্যোৎস্না, গাছপালায় শিশিরমাখা জ্যোৎস্না, সবই বিচ্ছেদহীন মনে হচ্ছে। অথচ আজ বাতাসে মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা সমুদ্রের মত গর্জন করছে। সীমানা হারানো মরুভূমি জ্যোৎস্নায় প্লাবিত–সেখানে ছুটে মরছে কালো অশ্ব–এই একটি ছবি। কোথাও নেই। অথচ মনের ভিতর রয়েছে। সাদইদের বুকের ভিতর একটা পাপের উৎস খুলে যায়। সহসা সে রিবিকাকে জাগিয়ে তোলে।
রিবিকার ঘুম জড়ানো, যেভাবে একটা চুল তার গালের উপর জড়ানো, ঈষৎ জেগেছে, নিদ্রাভিভূত সুন্দর, শুভ্ৰপুষ্প কলিকার মত কোমল-একদিকে ভয়াল যুদ্ধ, অন্যদিকে একা এই নারী–এখানে কী কাজ সাদইদের? মহাপিতা নোহ এই নারীকে কেন রক্ষা করেছিলেন?
জড়ানো গলায় রিবিকা বলল–তুমি ঘুমোবে না সাদইদ?
হঠাৎ মন্থর গলায় সাদইদ বলল–ভাড়াটে সৈনিক আর দেবদাসী। এভাবে বাঁচা যায় না রিবিকা!
ঘুম থেকে চমকে মুখ তুলে চাইল রিবিকা। তারপর বলল–তুমি তো সারগন সাদইদ!
তারপরই দু’চোখ মুদল এবং সাদইদের কোলে মুখ গুঁজে দিল রিবিকা।
সাদইদ কণ্ঠস্বর সামান্য কঠোর করে বলল—কিন্তু তুমি ইয়াহোর জন্য আজ উৎসর্গ হয়েছ আমনের বউ। তোমাতে আমার অধিকার নেই।
এবার মুখ তুলে উঠে বসল রিবিকা। সাদইদের গালে কোমল স্পর্শে হাত বুলিয়ে বলল–জীবন কেন এরকম বলতে পারো? যুদ্ধের দুনিয়ায় ঈশ্বরও করুণা করেন না। তুমি বলেছিলে, মানুষ ক্ষমতাধর! সেই ক্ষমতা কি এত ক্ষুদ্র যে, অধিকারের কথা তুলছ? কেন বারবার এমন করো!!
সাদইদ বলল–পাপ আমাকে উতলা করেছে রিবিকা? আমি পারছি না।
–তোমাকে পারতে হবে সাদইদ! আবার গড়ে তুলতে হবে! একদিন বলেছিলাম, তোমার তৈরি ভাষায় কথা বলব না, তোমার স্বর্গকেও আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু তোমাকে চেয়েছি সারগন!
–কেন চেয়েছ! আমি তোমাকে এতদূর টেনে এনেছি শুধু স্বর্গে পৌঁছব বলে। তা যে অবাস্তব। আজ হয় ইয়াহো, নয় হেরা। একদিন প্রশ্ন ছিল, কার কাছে দেব–রাজা হিতেন, নাকি লোটা। দুজনের কেউ তোমায় পায়নি।
-হেরা কেন?
–তোমার নগ্ন রূপ তার বিষয়।
–আমি যাব না। কিছুতেই যাব না। এই রূপ তো তোমারই সারগন। নমরু, আক্কাদ এরা যে কেউ কখনও আমার এত দাম দেয়নি!
–হেরার চোখে তুমি আরে দামী রিবিকা। সে স্থপতি, সে ভাস্কর!
–কিন্তু তুমি স্বর্গদর্শী সাদ! প্রজাপতি তোমার বন্ধু!
–তাই আমার পাপ! আমি বুঝিনি, মধুতে যখন প্রজাপতি লিপ্ত হয়, সেই ঘটনায় পাপ ছিল! অতি-কল্পনায় পাপ থাকে। স্বর্গের কাঠামো মানুষের পাপের পাঁজর দিয়ে তৈরি। ইহুদ বলেন, গ্রামকে শুষে তবে নগর তৈরি হয়, একটা স্বর্গ হল তারই চুড়া! অতএব তোমাকে ইহুদের কাছেই ফিরে যেতে হবে রিবিকা! আমি তোমাকে বইতে পারছি নে!
হঠাৎ রিবিকার মুখ কালো হয়ে গেল! যেন জ্যোৎস্নার চাঁদের গায়ে মেঘ এসে লেগেছে। ক্রমশ কালো হয়ে আসছে সমুদ্র-ছায়া।
রিবিকা ধীরে ধীরে নৌকার উপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল–তুমি রাজা! এই তোমার অহংকার সাদইদ। গ্রাম বসালে, চাষ-আবাদের নতুন নিয়ম আনলে। স্বর্গ গড়তে চাইছ। যুদ্ধ করেছ। তুমি অধিপতি। আমি সামান্য দেবদাসী। যতবার যাকে খুশি দেওয়া যায়। আমি যুদ্ধের পরিত্যক্ত জিনিস। আমাকে দিয়ে স্বর্গ গড়া যায়, যুদ্ধও করা যায়। দেবী ইস্তার আমাকে নগ্ন করেছে, আমন ভোগ করেছে, ইয়াহো তারই শোধ নিলেন নোটাকে দিয়ে। সবই হল!