হঠাৎ মনে পড়ল, আজ নববর্ষের দিন! রাত্রি নামল। চাষীর ঘরে ফসল ফলেছে সুপ্রচুর। সাদইদ উদ্বৃত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে বাধা পেয়েছে বিচিত্র ধরনের। ইয়াহোর বান্দারা অনেকেই দিতে চায়নি। সাদইদ তবু হেরাকে উপত্যকা ঘিরে প্রাচীর খাড়া করতে বলেছে। পথ তৈরি হয়েছে। আজ আগুন লাগল কেন?
হেরার চোখের সামনে সব ভস্মীভূত হতে লাগল। তাঁবুর পশুরা পুড়ে গেল। চাষীর ঘর জ্বলল। পথের উপর পড়ে রইল মৃতদেহ। বিদেশী সংখ্যালঘু কুমোরদের বউ,কন্যা ধর্ষিতা হল। ঘটনা কেন ঘটল? দু’জন দেবদাসী খুন হয়ে গেল। দেবদেবীর অভিনয়ের রাত বিষাক্ত বিষাদে ছেয়ে গেল। নিশ্চয়ই কোন সেপাই চাষী ঘরের মেয়েকে বলপ্রয়োগের চেষ্টা করে–এমন একটা বিবরণ শোনা যাবে বাতাসে। কিংবা কুমোরদের কোন ছেলে তাঁর মেয়ের উপর নষ্টামির চেষ্টা করে। বলা হবে,এই ঘটনায় কনানীদের কোনওই ভূমিকা ছিল না। অথবা তাঁবুর বসতি আছে বলেই দাঙ্গা বেধেছে, স্বর্গ না গড়তে চাইলে এমন হত না!
হেরা চোখের সামনে দেখতে পেল আলো-অন্ধকার মেশানো একটা কুটির থেকে কচি একটি মেয়ের হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনছে দিনারের মত একজন কেউ। হাতে ধরেছে ধারালো তৃতীয়ার চন্দ্রাকৃতি গোল অস্ত্র। কিশোরীটি চিৎকার করছে। মেয়েটির মুখের আদল অনেকটা নিনিভার মত। হেরা বুঝতে পারল, নিনিভার বাপের সংসারে অত্যাচার কখনও থামেনি। বাপ বেচারি কী করবে? তার তো করার কিছু নেই। এতগুলি মেয়েকে সে সামলাতে পারছে না। ইয়াহোর ধর্ম গ্রহণ করার পরও, কনানের পুরনো ধর্ম তাকে ছাড়ছে না। কুমারী বলি হয়েছে, আজ নববর্ষে অন্য মেয়েটিকে টানছে এক মরুজাতক সেপাই।
ধর্ষণে উদ্যত দিনারের একটি ছায়া, দিনার কিনা বোঝা যায় না–অশ্বের পায়ের শব্দে চমকে উঠে কিশোরীর গলায় অস্ত্র পেঁচিয়ে দিয়ে অন্ধকারে গা-ঢাকা দিল। কিশোরীর দেহ সামনে পড়ে লাফাচ্ছে, গলা দু’ফাঁক হয়ে গেছে পশুর মত। হেরা অশ্য ধাওয়া করে দিনারকে পেল না। হঠাৎ নারীকণ্ঠের আর্তনাদে তাঁবুতে এসে দেখল নিশিমা খুন হয়ে গিয়েছে, তার মাথার কাছে মড়া আগলে বসে আছে এক বৃদ্ধা, সেই বৃদ্ধাই মাঝে মাঝে ককাচ্ছে ভয়ে। হেরা পাগলের মত ছুটে এল পাহাড়ের দিকে। এখানে নাকি ইহুদ থাকেন।
দেখা গেল, ইহুদ কতকগুলো মানুষকে, যারা অধিকাংশ মরুসৈনিক, নির্দেশ দিচ্ছেন–ছুটে যাও। বন্ধ করো তাণ্ডব।
হেরা বলল–যা হবার তা তো হয়েই গেছে মহাত্মা! সম্ভবত আপনার দিনার এইমাত্র এক কিশোরীকে খুন করে অন্ধকারে ছুটে গেল। এবার থেকে আমরা এক ক্ষমতাশালী সৈন্যদল গড়ে তুলতে বাধ্য হব!
তারপর সবচেয়ে বড় বাঁধটা রাতারাতি কেটে দিল কে, জানা গেল না। খরা এল অতঃপর। দগ্ধানো গ্রামের ভস্ম মরুর হাওয়াআকাশেওড়াতে লাগল। বালি উড়ে এসে খাল বুজে যেতে লাগল। পাথর গড়িয়ে পড়তে থাকল পাহাড় থেকে। উপত্যকার মধুচক্র শুধু মোম হয়ে ঝুলে থাকল হলুদ বর্ণে। রাত্রে গ্রামের ভিতর মৃত্যুর রোল উঠতে লাগল। মরু-হায়েনা হানা দিল রাত্রির গভীরে। শেয়াল ছুটে এসে মড়কলাগা পশুর দেহ ধরে টানাটানি করতে থাকল। নীল সমুদ্র হল ধূসর। মিশালের নৌকা অস্থির হয়ে দুলতে থাকল কেবল। দেবদাসীরা তাঁবু ছেড়ে নেমে এল পথে। চাষার ঘর থেকে মেয়েরা নেমে এল পথে। ভাঙা কুটিরে ফেদে বসল দেহের ব্যবসা। কিন্তু খদ্দের জোটানো দায়।
একদিন একটি মেয়ে হেরার হাত ধরে টানল।–এসো না গো! ঘরে আঙুর গেঁজানো মদ আছে।
হেরা চমকে উঠে দেখল, মাথাটা গেছে–এই কি নিনি! নিনি হেরাকে চিনতে পারল না। ভাঙা পাল্লা বন্ধ করে চিৎ হয়ে বসন আলগা করে দিল। হেরা তাকে সম্ভোগ করতে পারল না। পালিয়ে এল। এবার তার মনে হল, সব মিথ্যা! কোথাও নিশ্চয় পাপ করছে মানুষ, কী পাপ বুঝতে পারছে না।
ক্রমশ সে পাগল হয়ে যেতে বসল। বাতাসে পোড়া গন্ধ কিছুতেই দূর হতে চাইছে না। অধিকাংশ পশু মড়কে ফৌত হয়ে গেছে। তাঁবুর মানুষরা গাছের তলায় বসে আছে। যে লোকটির দুটি বউ–তাঁবুর বউ আর কুটিরের বউ–তার অবস্থা খুবই করুণ। কুটিরের বউ তার কাছে আসতেই চাইছে না। চাষাতে চাষীতে খুনোখুনি হয়ে গেছে। পুঁটকি মাছ আর কাঁকড়ার বিবাদ। হেরার মনে হল, মানুষ কখনওই খুনোখুনি ছাড়া থাকতে চায় না। দাঙ্গা, রক্তপাত, ধর্ষণ, মারী, মড়ক, দুর্ভিক্ষ, খাদ্যাভাব, পথে বসে পড়া তার প্রাগৈতিহাসিক অভ্যাস। যুদ্ধ তার নিয়তি । নগর তৈরি হলেই সেটা সে ধ্বংস করে। সুন্দরী মেয়েকে বলাকার করা, বলি দেওয়া তার কাজ। চিরকাল সে ধ্বংসে আর বলাৎকারে আনন্দ পায়। নির্মাণের আনন্দ দু’এক জনের, ধ্বংসের আনন্দ সবার। নির্মাণের আনন্দ তাকে বোঝাতে হয়, তবে বোঝে–কিন্তু ধ্বংসের আনন্দ বোঝাতে হয় না।
যে যত ক্ষমতাশালী, যে যত সভ্য, সে ততই ধ্বংস ভালবাসে। বিনাশ হল মানুষের প্রবৃত্তি। ঈশ্বর যেমন ধ্বংস করেন, মানুষও তেমনি ধ্বংস করে। দেবদূতরা সুযোগ পেলেই আকাশ থেকে নেমে এসে মানবীর গর্ভসঞ্চার করে। বলাৎকার করার অভ্যাস দেবতারা মানুষকে শেখান। একমাত্র ঈশ্বর যবহ অদৃশ্য, তাঁর বলাৎকারের অভ্যাস নেই, তবে মানুষের হাতে গড়া নির্মাণ দেখলেই তিনি কুপিত হন। ভাষাভেদ করেন। বিচ্ছিন্ন তিনিও করেন। তিনি পাপ দ্বারা মানুষকে শোধন করেন, ধুনুরি যেমন তুলা শোধন করে। নগরগুলি ঈশ্বরের কর্মক্ষেত্র, সেখানে মানুষকে পেঁজানোনা তাঁর কাজ, ধ্বংস করা তাঁর আনন্দ।