হেরা আবার হাসল। বলল–আমি তো তোমার মত কর্মের মানুষ নই, চিন্তাবিদও নই। সংগঠন যারা করে তাদের চিন্তাও খুব গঠিত হয়–যেমন মহাত্মা ইহুদ–সব হল লাঠির ইশারাগুছিয়ে ভোলা। আমার হয় না।
–-আচ্ছা, কী বলছিলে বলে দাও। তারপর খুব দ্রুত মূর্তিটার কথা ভাবো!
–মূর্তিটাকে আমি তুক করছি সাদইদ!
সাদইদ চমকে উঠল। তুক বলার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তে সাদইদের চোখের উপর প্রাচীন পর্বতগুহা ভেসে উঠল। পুরনো পাথরমারা মানুষ গুহার দেওয়ালে শিকারে যাওয়ার আগে শিকারের ছবিটা আঁকত–এটা তার হৃদয় থেকে, মানে স্বপ্ন থেকে আসত। তারপর আঁকা ছবিটার ওপর তুক করত। তুক করলে বনে গিয়ে সেই আঁকা ছবিটাই সে জ্যান্তরূপে শিকার করতে পারত। ফলে ছবি বা মূর্তি থেকে তার নড়বার উপায় নেই। সাদইদ ভাবল, আমিও কি পারছি? তাহলে হেরাই বা পারবে কেন? কিন্তু সে কাকে তুক করছে?
সাদইদ বলল-খুব কষ্ট হয় হেরা! সবই তুমি হারিয়েছ, কিন্তু তুক করে সেইসব কি ফিরে পাবে? মাটির তৈরি নিনিভাকে রক্তমাংসে ফিরে পাওয়া–
হেরা সঙ্গে সঙ্গে বলল–না সাদ!
–তবে?
–এ তো রিবিকা স্বর্গদর্শী সারগন! আমি তার নগ্নতা দেখিনি। তাকে দেখাও–আমি নিনিভার রূপ থেকে মুক্ত হই! আমি হৃদয়ের শেষ শক্তি দিয়ে ভেবেছি কিন্তু পারিনি। বারবার নিনিভাই চলে আসে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি পারব!
বলতে বলতে হেরার গলা বুজে এল। একটি অঘটন হল। একটি পাগলা পাথর এই ঘোর হতে থাকা সন্ধ্যার হালকা তিমিরে তৃতীয়ার চাঁদের কোমল। কিরণ মেখে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়তে থাকে। ক্রমাগত পড়ে যেতে থাকে। লাফিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে। একদণ্ড থামছে, কি থামছে না। নিচে ছুটছে একটা বিধ্বংসী ক্ষমতার মত। এ ঘটনা এই পাহাড়ে এই প্রথম।
এই প্রথম জীবনে সাদইদ মুখ ফসকে উচ্চারণ করল সুতীব্র হতাশার সুরেহায় ইয়াহো! এমন তো ভাবিনি।
হেরা বলল–হাঁ, আজ কত মরবে কে জানে! খুব সাংঘাতিক এই পতন। চেয়ে থাকলে মনে হয় এই উপত্যকাটাই যেন বসে যাচ্ছে।
সাদইদ সাদা অশ্বে লাফিয়ে উঠে বসে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। হেরা পিছন থেকে আর্তনাদ করে ওঠে–ওভাবে যেও না সারগন!
তারপর কী ভেবে হেরা একা এই জনশূন্য নির্জনে অট্টহাস্য করে বলে–তুক। তুক করছি ওহে পাথরঅলা! ওহে রুদ্র, তুমি কে? অদৃশ্য, তুমি কে হে! মহাত্মা ইহুদ, আমায় গ্রহণ করুন পিতা! আমি তোমার স্বর্গে যেতে চাই। আমার সংলাপ শুনছে এই উপত্যকা! কেউ শুনছে না। আমিও শুনছি না। হা হা হা হা! হা হা হা!
হাসি শুনে সোনালী অশ্ব হেরার কাছে ঈশ্বরের মত এগিয়ে আসে। অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসতে থাকে হেরা। রাস্তার দু’পাশে দোকানপাট আলোয় উজ্জ্বল বীণা বাজিয়ে গান গেয়ে চলেছে এক অন্ধ গায়ক, তার গাইবার বিষয়বস্তুটি ভারী সুন্দর।
‘দুধের রাস্তা রাজা খুবই মধুর
এখানে ডুমুর রুটি, এখানে কেবলই সুর।
তবু তোর পাপের ভারা টানবি আর কতদূর–
এখানে তাঁবুর বাজার, এখানে কেবলই সুর।
এখানে তাঁবুর পাশে চাষীদের কুটির আছে,
এখানে মরুর হাওয়া, পাথরে ফুল ফুটেছে।
সব তোর নিজের গড়া, সবই তোর স্বপ্ন রাজা–
মাটিতে দুধের নদী, মধুর ওই উপত্যকা,
সব তোর আকাশ-ছোঁয়া, সবই তোর মাটির টানে
তবু যে পাপের ভারা ডুবে যায় নদীর বানে।
তুই তো বিম্ব ছায়া, তুই তো লোটার ছায়া–
যে রয় মরুর মাঝে যে হয় আসল কায়া;
সে আছে ঝড়ের মুখে, সে আছে মারীর বুকে
সেই যে আসল রাজা, আসবে কনান দেশে।
তার বিবিকে তুই কেড়েছিস, তুই যে রাজা অসুর–
দুধের রাস্তা রাজা খুবই মধুর।’
একটু থেমে আবার গাইছে :
‘তুই যে হত্যাকারী, শিশুকে তুই মেরেছিস,
তুই যে হত্যাকারী, ঘোড়াকে তুই মেরেছিস–
তবু তোর সুনাম করি, তুই যে শান্ত অধীর
কে জানে কী করেছিস, রিবিকা কোথায় আছে;
এখানে মরুর হাওয়া, পাথরে ফুল ফুটেছে।
এ বীণা আমার বীণা, কেড়ে তুই নিস না জানি–
লোটাই আসল রাজা, রিবিকা আসল রানী।
এই সুর কেবল এ সুর, গেয়ে যাই আপন মনে–
তোর ওই স্বর্গে যেন ইয়াহো পাথর হানে।
নতুবা স্বর্গ তোমার ইয়াহো উঠিয়ে নেবেন,
আকাশে নিজের কাছে, আকাশে নিজের কাছে–
এখানে নদীর হাওয়া, আকাশে চাঁদ উঠেছে।’
হেরা বীণাবাদকের গান শুনতে শুনতে আশ্চর্য বোধ করছিল। সে বুঝতে পারছিল, পাপ কীভাবে জাল ছড়িয়ে চলেছে কনানের সর্বত্র। সাদইদ কোনদিনই এই মাটিতে প্রতিষ্ঠা পাবে না। তার এই স্বর্গকে কেউ বিশ্বাস করে না। তাকে ইহুদ হত্যাকারী এবং লুণ্ঠনকারী ঘোষণা করেছেন। মহাপিতা নোহের নৌকাকে নোহের পুত্র অবধি বিশ্বাস করেনি। পিতার নৌকায় পুত্ৰ উঠতে চায়নি। পুত্র বন্যায় তলিয়ে গেল, তথাপি পিতার নৌকায় উঠে এল না। কিন্তু কেন এমন হয়?
বীণাবাদক জানে, সাদইদ তার বীণা কেড়ে নেবে না। এই বিশ্বাস তার অন্তরের, কিন্তু উপত্যকায় যে স্বর্গ তৈরি হচ্ছে তাতে তার আস্থা নেই। কিন্তু কেন?
সমতলে নেমে আসার আগেই হেরার চোখে পড়ল আকাশের তলায় এক সর্বগ্রাসী আগুন লেগেছে। দ্রুত ঘোড়া ছোটাল হেরা। এই ভয়াবহ দৃশ্যের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। অনেকটা কাল কেটে গেছে এই কনানে আসার পর। প্রতিটি পাথর এখানে গেঁথে ভোলার মেহনত সীমাহীন। পথের প্রতিটি স্তর খাড়া করা মুখের কথা নয়। কতবার শ্রমিক কারিগর মিস্ত্রী, চাষনালার চাষী সব ছেড়ে পালিয়ে গেছে। মাঝপথে নির্মাণের কাজ থেমে পড়েছে। তবে এখানে। আর ভয়াবহ বন্যা কিংবা সাংঘাতিক খরা হয়নি। একটু-আধটু যা হয়েছে, তার সম্পূর্ণ মোকাবিলা করেছে সাদইদ। এখানে বাজার বসেছে, কুটির তৈরি হয়েছে। কিন্তু কুটির আর তাঁবুর লড়াই থামেনি। পূর্বদেশী চাষী বা শ্রমিকের সঙ্গে কনানের বিবাদ, বিদ্বেষ দূর করা যায়নি ইয়াহোর নির্দেশে। কখনও কখনও মনে হয় সমস্ত চেষ্টাই অবান্তর। .