তার শিশু নেই। প্রথমে সে এই সংবাদ বুঝতেই পারল না। বারবার তাকে বলা হয়, খোকা নেই হেরা! তোমার শিশুকে কে একটা পাগল, জিব্রিল,মেরে রেখে গাছের তলায় ফেলে চলে গেছে। পাথরঅলা একটা লোক! বুঝতে পারো না, তোমার লকেট-ঝোলানোনা শিশুটি আর নেই। হতে পারে গর্ভবতী বউটাই হয়ত মেরে ফেলেছে। আপন মা তো নয়। সে কি আর মধু খাওয়াবে, গরলই গেলাবে!
১১-১২. সোনালী অশ্বের পিঠে
সোনালী অশ্বের পিঠে চড়ে হেরা সোজা উপত্যকার কালো আঙুরের মত নিবিড় মধুচক্রের কাছে উঠে এল। এতবড় প্রশস্ত পথ নিনিভেও ছিল না। পথের দু’পাশে বাজার-পাট বসতে শুরু করেছে। কনানের সমস্ত পথ সবার জন্য উন্মুক্ত। ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে নানান দেশের সঙ্গে। নগর প্রতিষ্ঠার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। উচ্চতার দিকে উঠে গেছে পথ, তারপর সিঁড়ি তৈরি হচ্ছে, যেভাবে কল্পনা করা যায় একটি দুধের রাস্তা নক্ষত্র থেকে নেমে এসেছে মাটিতে, আকাশে দুধের রাস্তা দেখা যায়।
একটি তৃপ্তির খাস ফেলে হেরা নিজেকেই বলল, এখানেই অতএব অমরাবতী। সাদইদের কক্ষ। কক্ষের ভিতর নগ্ন নারী। শুধু প্রমাণ করা যে, রিবিকার হুবহু নকল করা হয়েছে এখানে, যাতে দুটি সত্যিকার প্রজাপতি উড়ে এসে রিবিকার বুত্রে উপর বসে। কিন্তু এটা কি আদৌ প্রমাণ করা সম্ভব! যদি তা প্রমাণিত না হয়, তবে বলা যায় না যে এটি মানুষের গড়া স্বর্গ! স্বর্গ প্রমাণ সাপেক্ষ, তা শুধু ঘোষণা-করা কোন ফলকাকীর্ণ লিপি নয়। সাদইদ বলেছে, যদি প্রজাপতি না উড়ে আসে,বুঝতে হবে এই নির্মাণ মিথ্যা। তাহলে সমস্তই ভেঙে ফেলতে হবে। ভাবলেই মনটা কেমন দমে যায়।
হেরা আবার নিজেকে বলল, সব জিনিসের যেমন চুড়ো আছে, তেমনি সৌন্দর্যেরও চুড়ো আছে। সেখানে স্থাপন করতে হবে রিবিকার নগ্নতা। কিন্তু রিবিকাকেই যে কখনও দেখিনি। সাদইদ তাকে লুকিয়ে রেখেছে। নগ্নতা না দেখলে নগ্নতা উৎকীর্ণ হয় না। নগরীটা বুকের মধ্যে আছে, রিবিকা তো বুকের মধ্যে নেই।
সামনের অর্ধসমাপ্ত মাটির নগ্ন নারীমূর্তির দিকে চাইল হেরা। ভাবল, বাকি কাজ পরে হবে। কাজটা দু’চার দিনের নয়। তবে এ মূর্তি তো রিবিকার নয়। এ যে নিনি। কী মুশকিল। শিশু গেল হত্যায়। বউ গেল পালিয়ে। কেন গেল? বোবা মেয়েটিকে সে ভাষা দিয়েছিল। কিন্তু রইল না। পড়শীরা হত্যার দায় চাপাল নিনিভার কাঁধে। ক্রমাগত বলতে থাকল, এই মেয়ে মরুরাক্ষসী! বাচ্চাকে শুষে নিয়েছে। অবিরাম বলতে থাকলে মানুষ না-পালিয়ে কোথায় যাবে!
ভাবতে ভাবতে হেরার তৃপ্তির শ্বাস বেদনার দীর্ঘশ্বাসে বদলে যায়। এই কনানে আমি কেন এসেছিলাম? বউ আর শিশুর টানে,আর এসেছিলাম কাজ পাব বলে। কিন্তু যুদ্ধ মানুষের আকৃতি ভেঙে দেয়, লুপ্ত করে রূপ আর কাঠামো–একটা শ্বাসরুদ্ধকর অদৃশ্য জগৎ তৈরি করে। কিন্তু যুদ্ধ তো থামল না কখনও। মারী মড়ক বন্যা দুর্ভিক্ষ যেমন পালা করে আসে–বন্যা, অতঃপর মড়ক এবং দুর্ভিক্ষ, সেইভাবে হত্যা ধর্ষণ ইত্যাদি, এইসব ক্রিয়া চলতেই থাকে। মানুষ বস্তুত এইরকমই। যা হারাচ্ছে নিয়ত, তাইই সে নিয়ত খুঁজছে।
মাটির মূর্তির দিকে অপলক চেয়ে আজ জীবনের কত কথাই না মনে পড়ে যাচ্ছিল। এমন সময় আকাশমুখী পথ বেয়ে অপরূপ উপত্যকার দিকে এই সন্ধ্যাকালে উঠে আসে সাদা অশ্বারোহী দেবদূতের ক্ষিপ্রবেগ–সাদইদ।
অশ্ব থেকে অবতরণ করতে করতে বলে–আর কতদূর হেরা! স্বপ্নদর্শী ইহুদ বলে বেড়াচ্ছেন রাত্রের আকাশে বৃশ্চিক তারকার উদয় হয়েছে। যুদ্ধ ধ্বংস আর মড়ক অনিবার্য! আমি শুধু ভাবি আকাশে চাঁদ যে সভা বসিয়েছিল সে দৃশ্য। তিনি দেখেননি।
হেরা হেসে উঠে বলল–আমি শুনেছি অন্য এক কথা। যেসব মা বাপ শিশু সন্তানদের যুদ্ধে মরুভূমির বুকে হারিয়ে ফেলেছে এবং যে-শিশু তার মা-বাপ পায়নি আর যে-দেবদাসী স্বামী পেল না, যে-সৈনিক পেল না ঘর–ইয়াহোর স্বর্গে তারা নিশ্চিত সমস্তই ফিরে পাবে এবং মিলিত হবে। এই বক্তৃতা খুবই নতুন। বৈপ্লবিক বলতে পারো।
–তুমি শুনেছ?
–হ্যাঁ, শুনেছি বইকি! তোমায় লুকবো না। আমি গোপনে ভিড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে অনেক বক্তৃতাই উপভোগ করি। ইহুদ তাঁর অন্তর থেকেই বলেন। খুব স্পর্শ করে। কোমলমতি মানুষ তাঁর কথায় কাব্যের চেয়ে অধিক রস পায়। একদিন খোকা চলে যাবার পর ইহুদের বক্তৃতা শুনতে শুনতে মনে হল সব ছেড়ে দিই, ওঁর পায়ে গিয়ে পড়ে যাই। আমার মনের সেই অবস্থার কথা তোমায় বোঝাতে পারব না।
হঠাৎ সাদইদ খুব স্পর্শকাতর স্বরে বলে–আমি তোমায় কিছুই দিতে পারিনি হেরা! কিছুই পারিনি। বরং আমি কেবল তোমার কাছে চেয়েই চলেছি!
হেরা হা হা করে হেসে ফেলে মাটির মূর্তির দিকে চেয়ে বলে উঠল–কোন কিছু পাওয়ার ব্যাপারে একটা চমৎকার পুরনো পন্থা আছে সারগন। পাথরঅলাদের কথাই ধরো!
বলেই হেরা কাহিল করে হাসল। বলল–পাথরঅলাদের কথা মনে এলেই আমার অসম্ভব রোদন আসে। বাচ্চাটাকে মনে পড়ে কিনা। নিনিভাকেও তীব্র মনে পড়ে যায়। কান্না ঠেকানো যায় না। পাথর মেরে পশু শিকার করা নিশ্চয়ই অজ হাস্যকর। পশুপালন যখন করছি, প্রয়োজনের পশুগুলো তো আমাদের ঘরেই রয়েছে। কিন্তু পাথরঅলারা যখন পশুশিকার করে বেড়াত
সাদইদ বলল–শিল্পী মানুষ হলে যা হয় কথা তোমার ভাবাবেগে এলিয়ে পড়ে–এত বিস্তারিত কর যে, মূল ব্যাপারটা ধরতে খুব চিন্তা করতে হয়।