কারিগররা যখন চলে গেছে হেরা বলল-তবু তোমায় শুরু করতে হবে। সারগন।
অন্যমনস্ক সাদইদ চমকে উঠল। বলল–তোমার জন্য একটি সোনালী অশ্ব দরকার। তুমি, নিনি আর খোকাবাবু সেটায় চড়বে। উদ্বৃত্ত শস্য হবে অনেক। চাষীদের জন্য কাপড় আর তোমার জন্য ঘোড়া। ওরা বুঝল না হেরা! চলে। গেল!
সাদইদের কণ্ঠস্বর ভেঙে পড়তে চাইছিল। ফের কাঁপা কাঁপা গলায় সাদইদ বলল–এখানে পাথরের ফলক বসাও হেরা। তাতে লিখে দাও, এখানে পৃথিবীর প্রথম আক্রমণের নীতি বর্জিত হয়েছে। অতীতের ইতিহাসকে এই পথ ঘৃণা করে। একটা বসন টাঙিয়ে দাও, রক্তাক্ত কাপড় নয়। কোন লোহিত কম্বল নয়। ভয় নয়। একটি প্রজাপতি নির্ভয়ে উড়বে এমন একটা ছবি ভেসে থাক সেই বসনের উপর।
হেরা বলল–ফের আমি লোটার মূর্তি গড়ে তুলব সাদইদ! কিন্তু আক্রমণ ছাড়া বাঁচা যায় না। তোমাকে একটি পুরু প্রাচীর এবং সৈন্যদল গড়ে তুলতে হবে। প্রকৃত রাখতে হবে প্রচুর সাঁজোয়া। প্রচুর অখ। মনে রেখো হিতেন মরেছে। কিন্তু হিত্তীয়দের বিনাশ হয়নি।
হেরার কাঁধ খামচে ধরল সাদইদ।
হেরা বলল–একটা ভারী কথা তোমাকে বলতে চাই। নগর গড়া আর ধ্বংস করা–তারই যোগফল হল সভ্যতা। যারা ধ্বংস করে এবং অধিকার করে তাদের কথা মানুষের মুখের কাহিনীতে থেকে যায়। মানুষ ধ্বংস করে নগর। ঈশ্বর ধ্বংস করেন স্বর্গ।
সাদইদ শুধালো–তাহলে গড়ে কারা?
হেরা বলল–তুমি সেকথা ভাল করেই জানো! নোহের সন্তানরা গড়ে।
–কিন্তু গড়ে তোলে কেন বলতে পারো?
–সেকথা সহজ করে বলা যায় না। বলাই হয়ত যায় না। আমি কেন লোটার অশ্বারোহী মূর্তিটা বানালাম বলতে পারব না। ধ্বংসের ব্যাপারটা বলা যায়। নির্মাণের ব্যাপার বলা খুব মুশকিল। অহংকার?
বলেই হেরা চাপা গলায় অদ্ভুত হেসে উঠল। তারপর বলল–দুটোই কাজ। ধ্বংস করা একটা কাজ। গড়া একটা কাজ। মানুষ কাজ করছে। যার যেমন ভাল লাগছে করছে। তুমি ভেবো না, তুমি গড়ছ বলেই খুব মহৎ। যারা ধ্বংস করছে তারাও সম্মানিত। ঈশ্বর স্বর্গ ধ্বংস করেছেন বলে তাঁর কিন্তু মড়ক হয়নি। যারা রাজা তারা ধ্বংস করে বলেই রাজা। ধ্বংসের জ্ঞান এবং বুদ্ধিকে তুমি উপেক্ষা করতে পারো না। আগে ভাল করে পিষে দাও, কোমর ভেঙে দাও, কপিকলে জুড়ে দাও, তারপর ফলকে লিখে রাখো, আমি একটি পশুকেও আঘাত দিইনি।
সাদইদ বলল–আমি কিন্তু আঘাত দিয়েছি হেরা!
হেরা বলল–সেটা কখনও ফলকে লিখে রাখবে না। একটা মানুষ দুমড়ে ভেঙে পড়ছে, থলি টানতে পারছে না, নুইয়ে পড়ছে, এটা আঁকবে মানুষ যাতে দুমড়ে নুয়ে পড়তে শেখে, ভয় পায়। ক্রমাগত ভয় সৃষ্টি করতে না পারলে তুমি কখনও সারগন হয়ে উঠতে পারো না। জীবন থেকে তুমি কিছুই শেখোনি সাদইদ। রাজা হিতেনের সন্ধিফলক তোমার মনে নেই?
–আমি কিন্তু একটি স্বর্গের কথা বলছি হেরা!
–সেটা ধ্বংস করার জন্য ঈশ্বর আছেন!
–তাহলে আমি কী করব?
–তুমি মরো!
বলেই হেরা সাদা গাধার পিঠে গিয়ে লাফিয়ে উঠল। ছোট ছোট পা দ্রুত ফেলে ফেলে গাধা চলতে শুরু করল। তথাপি সাদইদের নগরনির্মাণের কাজ থামল না। আবার সে কারিগর, কাঠের এবং সুতোর কারিগর, মাটির কুমোর–সকলকে ধরে আনল। বাঁধ বাঁধবার চাষীদের, খাল কাটবার কুশলীদের সংগ্রহ করে আনল। ইহুদ আবার তাদের ভাগিয়ে দিলেন। হেরা কুমোরদের কাছে গিয়ে নকশা দেখায়। কল্পনা দেয়। নকশাদার একটা ভাঁড় রঙ করিয়ে পুড়িয়ে এনে দ্রাক্ষার রস পান করে পথের উপর দাঁড়িয়ে। মাথা পা টলমল করে। বাজে কথা বলতে থাকে–শালা সাদ! স্বপ্নের তোর সর্বনাশ করি রে সারগন! মধু টুপিয়ে পড়ে, দুধ গড়িয়ে যায়! ইয়ের্কি!
এই মত্ত অবস্থা তার কাটে না। সে বুঝতে পারে না এই যন্ত্রণার উপশম। কীভাবে হবে। রাত্রে ঘুম হয় না। বুকের ভিতরের নগরী তাকে স্বপ্নের ভিতর। টেনে নেয়। সে দেখে নগরী দাউদাউ করে পুড়ছে।
বাইরের দাওয়ায় শুয়ে আছে শিশু আর নারী। দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে সে। নারীর কাছে আসে, তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে নিনিভাকে সম্ভোগ করে–ঘরে আসে, মদ খায়। ঘুমানোর চেষ্টা করে। পারে না। ফের মদ খায়। আবার সম্ভোগ করে। বিছানায় শোয়। দুঃস্বপ্ন দেখে। পৃথিবীর সমস্ত মূর্তি ভেঙে পড়ছে। ঘুম চটে যায়। আবার সম্ভোগ করে। আবার মদ খায়। নিনিভা হেরার পায়ের উপর পড়ে গিয়ে বলে–তুমি পাগল হয়ে গেছ! আমি আর পারছি না!
রাত্রি-শেষে নেতিয়ে পড়ে হেরা। ভোর হয়। নিনিভারও ভয়ানক ঘুম এসে পড়েছিল। প্রত্যুষ জেগেছে। কিন্তু নিনিভার দেহ কিছুতেই জাগতে চাইছিল না।
ভোররাত্রির অন্ধকারে দুটি কালো হাত এসে নিনিভার কোলের কাছ থেকে শিশুকে তুলে নয়। ঘুমন্ত শিশুকে একটি গাছের গোড়ায় শুইয়ে দেয়। তারপর একটা ভারী ধরনের পাথর, যা ছুঁড়ে একদা মানুষ পশুকে ঘায়েল করত, তাই দিয়ে ঘুমন্ত শিশুর মাথা থেতলে দেয়। শিশু কেঁদে ওঠারও সময় পায় না। ঘুমের ভিতরই শিশুর মৃত্যু হয়।
মৃত শিশুকে ঘাতক গাছের গোড়ায় বসিয়ে দেয়। ঘাড় কাত হয়ে একদিকে কাণ্ডের উপর পড়ে থাকে। একই রাতে অন্য এক গাছের তলায় একইভাবে বসিয়ে রাখা হয় আরো একটি মৃতদেহ। সেটি এক দেবদাসীর।
সাদইদ ভোরে এসে হেরাকে মারতে মারতে জাগিয়ে তোলে, নইলে হেরা জেগে উঠতে পারত না। এই মার চপেটাঘাত মাত্র। চক্ষু টকটকে লাল। চোখ মেলল হেরা।