ইহুদ আর দাঁড়ালেন না। অনেকটা পথ যখন তিনি অতিক্রম করেছেন, সাদইদ অশ্ব ধাওয়া করে ছুটে এল। ইহুদ থেমে পড়ে ওর দিকে চোখ তুললেন। অশ্ব ছটফট করছে। লাগাম টেনে ঘোড়াকে সামাল দিতে দিতে সাদইদ বলল–লোটা আজ মূর্তি ছাড়া কিছু নয় মহাত্মা ইহুদ! আমার মনের ভিতর সে আছে–তার মূর্তি! তাকে বাইরে না আনলে আমার যেমন নেই, লোটারও মুক্তি নেই। যাকে ভালবেসেছি, তাকে ভেতর থেকে বাইরে আনাই তো আমার ধর্ম । একথা বোঝার জন্য আপনাকে আবার আসতে হবে এই মর্তে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে সুযোগ আপনার নেই। আপনি কখনও তেমন প্রত্যাদেশ পাবেন না। দুঃখিত মহাত্মা ইহুদ! রিবিকা দেবী নয়। সে আমার জীবন যুদ্ধের পাওনা। রিবিকার জন্য আমি বিশাল সৈন্যবাহিনী এবং প্রকাণ্ড নগরী গড়ে তুলব। আপনি শুনে রাখুন, আপনার লাঠির চেয়ে একটি অসি কিন্তু কম শক্তি ধরে না।
বলেই সাদইদ তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। পিছন থেকে ইহুদ চিৎকার করে বলে ওঠেন–ওহে সারগন! তুমি কিন্তু শুনে রাখো, নোটার এই মূর্তি ভাঙার জন্য আমি কাউকে নির্দেশ দিইনি। আকাশের দেবদূত রাত্রে এসে ভেঙে দিয়ে গেছে।
. ইহুদের জোরে জোরে বলা কথাগুলির কিয়দংশ সাদইদের কানে গিয়েছিল–সে তীব্র বেগবান অশ্বটিকে মোচড় মেরে ঘুরিয়ে মুহূর্তে ছুটে এল ইহুদের সামনে। বলল–কে ভেঙেছে বললেন?
–জিব্রিল!
–অ! আকাশ আর মর্তের ভ্রাম্যমাণ অদৃশ্য দেবদূত! তবে শুনে রাখুন, সেই জিব্রিলই কিন্তু গতরাত্রিতে ব্লিবিকাকে তুলে নিয়েছে আকাশে,আর লোটার ঘোড়াটিকে বর্শা, তীর ছুঁড়ে মেরেছে!
–হতে পারে! আমি অবিশ্বাস করছি না।
মৃদু ঘাড় নেড়ে সাদইদের কথা সমর্থন করলেন ইহুদ। সাদই অবাক হয়ে চমকে উঠল।
ইহুদ বললেন–জিব্রিল যদি সত্যিই তুলে নিয়ে থাকেন, তবে তিনিই এই তাবুর দুনিয়ায় তাকে ফেরত দিয়ে যাবেন। কারণ লোটা আর রিবিকা এই মর্তেই মিলিত হবে। জেনে রেখো সাদইদ, লোটার কামনা ছিল রিবিকার উপর। মরুভূমিতে যে-মিলন ঘটেনি, এই শস্যসবুজ কাননে, যিহুদায়, জেরুজালেমে সেই মিলন ঘটবে। ঘটতে বাধ্য! এর অন্যথা হতে পারে না।
বলতে বলতে আকাশে দু’হাত প্রসারিত করলেন ইহুদ।–হায় ইয়াহো। তোমার বান্দার প্রার্থনা মঞ্জুর কর পিতা! আমার উম্মতদের (মন্ত্রশিষ্য) মোনাজাত (প্রার্থনা) কবুল কর! পিতামাতা আমার নাম রেখেছিলেন ইহুদ! আমাকে সার্থকনামা করে তোলো ঈশ্বর। আমার অনুসরণকারীরা,ইহুদি! তাদের স্বপ্ন যেন বিফল না হয়! পিতা মুসা–তোমার ইহুদ যেন ব্যর্থ না হয়!
শুনতে শুনতে অশ্বারোহী সাদইদের মাথা নিচু হয়ে গেল। তার থুতনি এসে বুকে ঠেকল। মনে হল তার, সে অপরাধী। তার দু চোখে অশ্রুর পীড়া –গলার কাছে দলা পাকানো লোটার কামনা, যা ভালবাসায় করুণ, মরুতৃষ্ণায় ব্যাকুল। বুক তার খা খাঁ করছিল।
সাদইদ মাথা নিচু করেই বলল–আমার মত পাপীর জন্য তোমার ঈশ্বরের কাছে কোন প্রার্থনা নেই মহাত্মা ইহুদ!
কণ্ঠস্বর কাঁপছে। মাথা তুলল সাদইদ। চোখ দুটি প্রত্যাশায় সহসা উজ্জ্বল হয়, মনে হয়, মহাত্মা ইহুদের কাছে সে যেন তার স্বপ্নসাধ ভালবাসা মজুত করেছে, ইহুদের করপুটে, প্রসারিত বাহুতে তার হৃদয় জড়ানো, যেন তাবুর দূরবর্তী মরুদ্বীপের মত হাওয়ায় দুলছে।
ইহুদ গম্ভীরভাবে বললেন–হ্যাঁ আছে! তোমার হৃদয়ে সত্যের আলো পড়ক। প্রার্থনা করি।
বলেই ইহুদ অগ্রসর হতে থাকেন সামনের দিকে। যেতে যেতে বলেন–বাবিলের স্বর্গ ঈশ্বর নিজে হাতে ধ্বংস করেছিলেন। তিনি কখনওইতোমার হাতে ফিরিয়ে দেবেন না! তোমার জুমপাহাড়ী ভাষা যেমন গড়ে উঠতে পারে না, তোমার স্বর্গও গড়ে উঠতে পারে না।
হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছেন ইহুদ। আপন মনে বলে চলেছেন–ঈশ্বর সৃষ্টি করেন গ্রাম। মানুষ তৈরি করে নগর। তাই নগর বারবার ধ্বংস হয়।
সাদইদ বলল–অথচ পিরামিড টিকে থাকে।
ইহুদ সহসা দাঁড়িয়ে পড়ে অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বললেন–ওহে দয়াল সারগন! স্বর্ণ কিন্তু কিছুতেই টেকে না।
বলেই ইহুদ অদ্ভুত বাকা করে অট্টহাসি ছড়িয়ে হাঁটতে থাকলেন।
অশ্ব নিয়ে মাটির উপর সহসা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সাদইদ। সামনে এগিয়ে চলে গেলেন ইহুদ। প্রথমেই সাদইদের এই মুহূর্তে যেকথা মনে হল, তা হল, মানুষের কণ্ঠস্বর কী রহস্যময় হতে পারে!
তারপর তার শরীরে অদ্ভুত ক্রোধ তৈরি হতে লাগল। ক্রোধ যদি আগুন হয়, তাহলে তা এক সময় নিবে গেল। নিবে যাবার পর তার হৃদয় এক চাপা অনুশোচনায় ব্যাকুল হয়ে উঠল। সে কি তবে সত্যিই পাপ করেছে গত রাতে?
লোটার কামনা কি মরুমর্তে এখনও রিবিকাকে খুঁজছে! মরুভূমি সব সময় সবুজ মাটির দিকে তৃষ্ণার্ত জিভ বার করে চাটতে থাকে জল আর উদ্ভিদ, মরু গিরগিটির ললকানো পাতলা জিভের মত। নারীর শরীরের রূপ আর মায়া যেন মাটিরই গড়ন, ছায়াময় গাছ আর নীল জল এবং জ্যোৎস্না। পুরুষ উটের মত নিরবলম্ব গলা দোলানো জীব। পুরুষ এক বর্শা-বেঁধা কালো অশ্ব যে মরুভূমির দিকে মরবার জন্য তুমুল জ্যোৎস্নায় ছুটে যায়। ভাবতে ভাবতে সাদইদের বুক হাহাকারে মুচড়ে ওঠে।
কী পাপ করেছি আমি! বলে সে আকাশে মুখ তোলে। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে সাদা ঘোড়া। তাবুর সংসার পাতা গ্রামের প্রান্তসীমায় চলে আসে তার ঘোড়া। কেন চলে আসে, সাদইদ বুঝতে পারে না। সামনে তারবেড়া তোলা হয়েছে কেন? অবাক হয় সে! সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারে–কেন এই ব্যবস্থা!