ইহুদ সামান্য থেমে আবার বললেন–সাদই একজন লুণ্ঠনকারী। সে তাবুর পবিত্র নারী রিবিকাকে লুঠ করে নিয়ে গেছে । সেই অভিমানে লোটার অশ্ব ফিরে গেছে মরুভূমিতে । মহাত্মা লোটা সেই অষে চড়ে ফিরে আসবে। একদিন এই ইয়াহোভক্ত ইহুদের ধর্মরাজ্য গড়ে উঠবে। সেই রাজ্যে থাকবে আদর্শ গ্রাম। কখনও উদ্ধত নগর গড়া হবে না। নগর মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে। নিনিভে আমার বাবিল মানুষকে বিচ্ছিন্ন করেছে। জাতিভেদ এবং ভাষাভেদ ঘটিয়েছে। স্বর্গ ঈশ্বরের জিনিস। মানুষ আকাশে সৌধ আর তৃপ বানালেই, সিঁড়ি গড়লেই ঈশ্বরের স্বর্গ হেঁয়া যায় না ভাই। তা কখনও নিচেও নামে না। সব বস্তুর বিম্ব হয়। স্বর্গের হয় না। মর্ত মর্তই। মরুভূমি যেমন গ্রাম নয়। ইয়াহহ যেমন ইস্তার নয়–তেমনি স্বর্গ স্বর্গ-ই–মর্তে সেই ছবি আসে না। মানুষ নগর গড়তে পারে। স্বর্গ পারে না।
আবার থামলেন ইহুদ। তারপর বললেন–সাদইদের স্বর্গের জন্য একখানা পাথর যে পুঁতবে, তার জিভ খসে পড়বে। মহাত্মা লোটার স্ত্রী দেবীর মত পবিত্র। তার উপর বলপ্রয়োগ করলে ইয়াহোর বুক কেঁপে ওঠে। সেই পাপ বহন করার ক্ষমতা এই পৃথিবীর নেই। সাদইদ রিবিকাকে নিয়ে আপন হাতে বানানো স্বর্গে প্রবেশ করবে–তোমরা বাইরেই পড়ে থাকবে বন্ধু! মানুষের হাতে গড়া স্বৰ্গকে কখনও বিশ্বাস করো না। ফেরাউন কখনও প্রজার জন্য পিরামিড গড়েনি। প্রজার লাশ পথের উপর পচেছে, শেয়াল শকুনে টানাটানি করেছে। তোমরা ফিরে যাও!
–কোথায় ফিরে যাব আমরা?–একজন চিৎকার করে বলল।
–যেখানে খুশি যাও। এখানে থেকো না।
ইহুদ কুটির অঙ্গন থেকে বাইরে চলে আসেন। তখন সবে সূর্য উঠছে। চারিদিকে হালকা কুয়াশা। লাঠি হাতে, কম্বল কাঁধে রাস্তার উপর চোখ রেখে এগিয়ে আসছেন তিনি।
সাদইদ লোটার মূর্তির কাছে এসে দেখল, সেটি বিধ্বস্ত। মাথা ওপড়ানো, একটি পা ভাঙা, কোমর নড়বড়ে। হতাশায় অভিভূত চোখে নির্নিমেষে দেখছিল সাদইদ। মনে মনে ভাবল–এ দৃশ্য হেরা সইতে পারবে না!
ইহুদ সাদা অশ্বের কাছে এসে থামলেন! চোখ তুললেন সাদইদের বিমর্ষ চোখে। সাদইদ ইহুদের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল–এতক্ষণ আপনার বক্তৃতা শুনছিলাম মহাত্মা ইহুদ! স্বর্গ এই দুনিয়ায় সম্ভব কিনা জানি না। কিন্তু চাষীর পক্ষে প্রচুর ফসল ফলানো সম্ভব। সেই ফসল থেকে উদ্বৃত্ত অংশ একটি শস্যভাণ্ডারে আমি জমা রাখব। যেসব খালকাটা শ্রমিক এখানে এসেছে, তাদের তাড়িয়ে দিয়ে আপনার কী উপকার হবে! দুর্ভিক্ষ হবে, মানু খেতে পাবে না। তখন আকাশে বৃষ্টির দেবতার কাছে দু’হাত তুলে কাদবে আর কুমারী বলি দিয়ে অসহায় নারীর প্রাণনাশ করবে। এই কি আপনি চান?
গম্ভীর গলায় ইহুদ বললেন–আমি কী চাই, তুমি ভাল করেই জানো! কুমারী বলি আমিই রদ করেছি। ফসল বেশি হলেও ওই হত্যাকাণ্ড রদ হত না সাদইদ! তার জন্য এই লাঠির শাসন দরকার ছিল! কিন্তু উদও ফসল তুমি কেন শস্যভাণ্ডারে তুলবে? তুমি কে? তুমি অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে স্বর্গ বানাতে চাও–একথাও আমি সর্বসাধারণকে বলেছি! আজ আমি আর গামছাবালা নই সাদইদ। এই লাল কম্বল দেখে মানুষ বোঝে–এই মানুষটি যুদ্ধের শোক আর বিভীষিকা কাঁধে করে বইছে। মানুষ মরলে তোমার প্রাণ কাঁদে কিনা জানিনে, কিন্তু আমি সইতে পারি না।
সাদইদ বলল–এ কারণেই আপনি মহাত্মা। কিন্তু লোটার এই মূর্তি ভেঙে দিয়ে আপনি মহাত্মার কাজ করেননি। আপনি জানেন, লোটা বেঁচে থাকলে ফিরে আসত। লোটা নেই বলেই তার মূর্তিটা হেরা তৈয়ের করে এই রাস্তার উপর খাড়া করেছে। হেরা প্রচুর পরিশ্রম করেছে, দিনরাত ভেবেছে। লোটার মৃত্যু সে দেখেছে মহাত্মা ইহুদ! আপনি কেন ভেঙে দিলেন?
ইহুদ বললেন দ্যাখো সাদইদ! লোটার মৃত্যু ধারণা মাত্র। তার মৃত্যু হতে পারে না। মহারাজা হিতেনের মত বলশালী রাজচক্রবর্তীকে যে হত্যা করে, তার মৃত্যু নেই। কালো অশ্ব তাকে আনতে গেছে। সে ফিরে এসে রিবিকাকে উদ্ধার করবে। তোমার লাম্পট্যের গহ্বরেই তোমার পতন অনিবার্য সাদইদ। লোটার আর কোন রূপ নেই! ইয়াহো তুলে নিয়েছেন।
একটু হেসে ইহুদ বললেন–কোন মূর্তি দিয়ে মহাত্মা লোটাকে বাঁধা যায় না সাদ। সেই চেষ্টা কখনও করো না! মূর্তি গড়া পাপ।
সাদইদ বলল–মূর্তি দিয়ে চিন্তা করা সহজ মহাত্মা। নকশার ভাষা হল মূর্তির ভাষা। মূর্তি আবার সকল ভাষার চেয়ে শক্তিশালী। আপনি জেনে রাখুন, মানুষ মূর্তি বানাবেই। আকাশের ঈশ্বর মূর্তি বানিয়েছিল, সেগুলি মানুষ। মূর্তি গড়া একা ঈশ্বরের অধিকার নয়। মানুষেরও অধিকার।
–মূর্তি ধ্বংস করাও কিন্তু ইয়াহোর নির্দেশ। কারণ তার নিজের কোন রূপ নেই।
–মরুভূমির ঈশ্বরের কোন রূপ থাকে না মহাত্মা ইহুদ। কারণ সেখানে মাটি নেই। বালু মুঠিতে ধরে ছেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এখন মাটিতে এসেছেন। মূর্তির অধিকার আপনাকে মেনে নিতে হবে।
–তুমি তর্ক করছ সাদইদ! আমি বিতর্ক পছন্দ করি না। মূর্তির আড়ালে রয়েছে ব্যভিচার। যৌনাচার। মানুষ দেবদেবীর অভিনয় করে অবৈধ দেহমিলনের জন্য। বৃষ্টি হওয়া না-হওয়া তার উপলক্ষ। কেননা, এখন সে জেনেছে ইয়াহোর নির্দেশে বৃষ্টি হয়। অথচ সে মন্দির মণ্ডপে নববর্ষের ব্যভিচার ত্যাগ করেনি। তোমার হেরা নগ্ন দেবীর মূর্তি বানায়। এ পাপ। নারীকে উলঙ্গ করা পাপ সাদইদ। নগর নারীকে উলঙ্গ হতে শেখায়। দেবদাসী করে। মন্দির। হল পাপপুরী। যদি মন্দির কখনও পবিত্র হয়ে ওঠে, জানবে পৃথিবী সেদিন নেই। মন্দির মানে রক্তপাত, মন্দির আর মূর্তি মানে কুৎসিত যৌনাচার। তুমি মূর্তির অধিকার ছেড়ে দাও। ইয়াহোর ধর্ম স্বীকার করো। রিবিকা তাহলে তোমার হবে সাদইদ। নতুবা নয়।