প্রত্যেকটি তোরণ অতিক্রম করার সময় দেবীর হাত থেকে তাঁর দৈবশক্তির প্রতীকগুলি একটি একটি করে কেড়ে নেওয়া হয়। প্রত্যেক তোরণে একটি করে প্রতীক তিনি হারিয়ে ফেলেন। সাতটি স্তরে পেঁচানো পোশাক, প্রত্যেকটি খণ্ড খুলে পড়ে প্রতিটি তোরণের কাছে। যম তাঁর বস্ত্রহরণ করেন। দেবীমূর্তির দিকে চেয়ে ছিল রিবিকা। বুকে তার কেবলই কুঁড়ি ধরেছে। বারবার সে আনমনা হয়ে যাচ্ছিল।
পুরোহিত এবার চতুর্থ খণ্ড পোশাকটি খুলে ফেলছেন দেবীর গা থেকে। চতুর্থ প্রতীক একটি নৌকা, সেটি হাত থেকে নামিয়ে রাখলেন। এই সময় বিষয় শিঙা বেজে উঠল। মৃত্যুর স্বর যেন ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। রাঙা রাত্রি যে বিষাদে ভরে যায়, অন্তত রিবিকা বালিকা হলেও বুঝতে পারে। এই যে নৌকার, প্রতীক–এটা নোহের চিহ্ন। নৌকার পুচ্ছটাতে ফের উটের মুখ আর গলা। তা ছাড়া উটের বিগ্রহও আছে।
এই সময় খানিকটা গোলমাল বাধে। প্রতীক নামাতে গিয়ে পুরুত নাকি ভুল করেছেন। চতুর্থবার নামবে উটের চিহ্ন। ষষ্ঠবারে নামবে নৌকা এবং অবশেষে বৃষমূর্তি। বৃমূর্তি হল চাষীর চিহ্ন। দেবী ষষ্ঠ তোরণ পর্যন্ত মহাপিতা নোহের নৌকায় করে যেতে পারেন। সপ্তম তোরণে গিয়ে বৃষের পিঠ থেকে পড়ে যান। অতঃপর নগ্ন দেবী ভাসতে ভাসতে গিয়ে রানী এরেসকীগালের কাছে উপস্থিত হন। এই কাহিনী ইস্তার পুরাণে লিখিত আছে। পুরোহিত সেই পুরাণ পাঠ করে চলেছেন মন্ত্রস্বরে। বস্ত্রহরণ করছেন যম। এই অনুষ্ঠানে পুরাণ-পাঠ আবশ্যিক।
মণ্ডপের সামনে থেকে নড়তে এতটুকু ইচ্ছে নেই রিবিকার। অথচ আক্কাদের মা বারবার ডেকে পাঠাচ্ছে। কেন যে এভাবে ডাকছে এবং বারংবার আক্কাদ উঠের পিঠে ওঠাতে চাইছে বোঝা যায় না। উঠের পিঠে ওঠা মানে যে একজন কুমারীর পক্ষে খুব মারাত্মক, রিবিকা শুনেছে–কিন্তু দোলের এই রাত্রি তার কাছে কোনই আনন্দ বহন করে না। প্রথমে বুঝতে না পারলেও ক্রমশ রিবিকার মনে হচ্ছিল, তার বিপদ হবে।
দেবী ইস্তারও কুমারী। তামুজদেব তাঁর প্রেমের উপাস্য পুরুষ। তাঁর সঙ্গে অবৈধ মিলনে আকাশে মেঘ জমে, মাটি উর্বর হয়। মাটির সঙ্গে চাষীর হলের সম্পর্ক, বলপ্রয়োগের সম্পর্ক। যে দেবী তামুজকে উদ্ধার করেন, তাঁরই যৌন-প্রহারে দেবী দুঃখ এবং আনন্দ পান। পুরাণের মস্বরে সেকথা আছে। দুঃখ আর আনন্দ মেশানো দোলরাত্রি বিষাদে আচ্ছন্ন হয় এই মুহূর্তে।
দেবীর তরফে আর্তস্বর পুরুতের গলায় ধ্বনিত হয় :
‘আমাকে ছেড়ে দাও, যাতে আমি যে-দেশে গিয়ে কেউ ফেরে না, সেখানে যেতে পারার সান্ত্বনা পাই, জানি সে দেশ বিষণ্ণতার, সে দেশ অন্ধকারের। (ইয়োব ১০ : ২০-২১)।
এই পূর্ণিমা রাতে বস্ত্রহৃতা দেবীর বিসর্জন। আর্তস্বরে সমস্ত গ্রাম আর আলোকোজ্জ্বল নগরীগুলি মথিত হচ্ছে। একই সঙ্গে চুড়ান্ত দুঃখ আর আনন্দ পাওয়ার অনুভূতি রিবিকার হয়নি। তার জীবনে অবৈধ কোন প্রেমও নেই। সে জানে আক্কাদের উটের কুঁজটা নবী সালেহের কবরভূমি। যে নবী মাটিতে ঠাঁই পাননি মৃত্যুর পর। সমগ্রজীবন মরু আরাবার পথে পথে, ফোরাতের তীরে তীরে। তাড়িত হয়ে ফিরেছেন। শুধু তৃষ্ণার জল দিয়েছে মরুবাহক উট। উটই ছিল তাঁর দেবতা। সালেহের জীবনও ইস্তারের মত। দুঃখের রূপ তো একই। অসহায় যে তার একই কষ্ট। দেবী প্রতীক হারিয়ে অন্ধকার পাতালে প্রবেশ করেন, সালেহ ঘুরে মরেন মরুভূমির উষর পথে পথে।
প্রতি বছরই দোলরাত্রির দেবী-অর্চনায় উটের প্রতীক নামানোর সময় পুরুতে পুরুতে গোলযোগ বাধে। পুরোহিতরা অবস্থাপন্ন এবং প্রচুর জমির দখলদার। তারা সালেহের উপাস্যদের পছন্দ করে না। এরা যেহেতু মরু আরাবার যাযাবর জাতি, হানাদার–তাই ঘৃণ্য। এদের বাস্তু নেই, নির্দিষ্ট কোন বাসভূমি নেই, এরা তাঁবুতে থাকে। জোর করে পূর্বদেশীয়দের শস্যভূমিতে ছাগল মেষ উট নিয়ে ঢুকে পড়ে–জবরদখল করে জমি। এই অতীতে বহুবার ঘটেছে। পরে এরা বাস্তু পেয়েছে কিন্তু কখনই নিজস্ব ভূখণ্ড পায়নি, জবরদখল করাই এদের নিয়তি। এদের ইতিহাস দীর্ঘ। এরা যখনই নিজস্ব বাসভূমির জন্য কোন এক স্থানে তাঁবু স্থাপন করেছে, গ্রাম ও নগরের মানুষরা ক্ষুব্ধ হয়েছে।
অথচ দিনে দিনে এরা চাষীজীবনের সঙ্গে খুব একটা দূরত্বও রাখতে চায়নি। বরং মিশে যেতে চেয়েছে। তাদের যাযাবরী অনেক প্রথাকানুন ত্যাগ করে, কোথাও বালদেব, কোথাও দেবী ইস্তারের উপাসনা শুরু করেছে। চাষবাস শিখে স্থিতু হয়েছে। শুধুমাত্র মাংসভুক এই শ্রেণীর মানুষ তাদের কাঁচাখেকো বদনাম ঘোচানোর জন্য চাষীদের ঘরে বৈবাহিক সম্বন্ধ গজার চেষ্টা করেছে। কিন্তু চাষীরা আপন ঘরের গৌরীদান করতে হামেশা কুণ্ঠা প্রকাশ করে। বরং যাযাবর মেয়েদের ঘরে বউ করার পর চোর বলে খোটা দেয়। আসল বউ নয়, উপপত্নী।
রিবিকার মা ছিল কনানীয় পরিবারে দ্বিতীয় শ্রেণীর বউ। অর্থাৎ রক্ষিতার চেয়ে সামান্য উন্নত। উপপত্নী মাত্র। রিবিকার বাবা রূপে মুগ্ধ হয়ে পরিবারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁর থেকে মেয়েটিকে ঘরে তুলেছিল। পরে কালাজ্বরে বউটি মারা যায়। উপপত্নীর মেয়ে বলে বাতৃ আর জমিতে রিবিকার কোন আইনগত অধিকার ছিল না।
আক্কাদ ওকে পশুলোমর বিনিময়ে খরিদ করল। একজন যাযাবর বণিক চাইছে–পরিবার তেমন কোন আপত্তিই করল না। কেনই বা করবে!