সাদইদ বলল–লোটা তুমি এ কী করলে? আমার পাপ তোমার সহ্য হল না!
অশ্ব কান পাতল বাতাসে। মরুভূমি তাকে ডাকল লোটার গলায়–সালেহ-ও-ও-ও, হায় পিতা-আ-আ-আ…
.
১০.
পায়ে বর্শা বিঁধেছে দাবনা বরাবর। ঘাড়ে বিঁধেছে তীর। ছোট বর্শা এবং তীর ছুঁড়েছে শত্রু। এইসব বর্শা এবং তীরে বিষ মাখানো থাকে। অশ্ব কান পাতল বাতাসে। লোটা ডাকছে। আর তো বিলম্ব করা ঠিক নয়। ঘোড়া ছুটতে শুরু করল ।
সাদইদ রিবিকার পায়ের উপর আছাড় খেয়ে পড়ে গেল। রিবিকার নগ্ন বুকে মুখ রেখে ডুকরে উঠল। গলার স্বর থরথর করে কেঁপে উঠল। ভাঙা অধস্ফুট স্বরে সাদইদ বলল–আমি আর বাঁচব না রিবিকা!
অত্যন্ত অসহায় শোনাল সাদইদের গলা। বিষাদে মায়ায় পূর্ণ, কামনাহত, অথচ নিঃস্ব, বঞ্চিত সে স্বর। আহত অশ্ব তীব্রতম হ্রেষা ছড়াতে ছড়াতে গ্রাম অতিক্রম করে গেল। অশ্বের এই আর্তনাদ যুদ্ধের স্পষ্ট সংকেত।
শিশুর মুখকে নারী অত্যন্ত আদরে যেমন করে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে,রিবিক বক্ষলগ্ন সাইদের মাথাটিকে তেমনি সমাদরে নিবিড়তম আশ্লেষে চেপে ধরল। বলল–আমার ভালবাসার পাপে তোমার স্বর্গ গড়ে উঠুক সারগন। ভয় পেও না! আমার ঈশ্বর কে আজও জানি না। কিন্তু তুমিই আমার দেবশিশু, তুমিই দেবতা! আমি নাঙা দেবী। আমার জন্য তুমি বারবার জন্মাবে এই পৃথিবীতে! বস্ত্র দিয়ে আমার লজ্জা ঢাকবে।
কালো অশ্বের আহত উন্মাদনা সহ্য করা যায় না। কিন্তু সেই চাপে রিবিকার সব অবদমন অনর্গলিত উচ্ছ্বাসে হৃদয়ের রূপান্তর ঘটায়। সে বুঝতে পেরেছে, ইহুদের লোক লোটার অশ্বকে হত্যা করে গেল!
শান্ত এক সমাহিত ধ্যান-মূর্তির মত চাঁদটা স্থির। হাত বাড়ালে তাকে যেন ছোঁয়া যাবে মনে হয়।
সাদইদ বলল–এখানে আর এভাবে বসে থাকা ঠিক নয় রিবিকা!
রিবিকা শুধালো–কোথায় যাব?
–কোথাও আমাদের লুকিয়ে পড়তে হবে।
–চলো তাহলে, আর দেরি করো না!
সাদইদ তার নগ্ন দেবীকে সাদা ঘোড়ায় করে তীব্র বেগে নেমে এল উপত্যকা থেকে। নদীর তীর বরাবর ছুটতে থাকল অখ। রিবিকার মনে পড়ল, এইভাবে সে একদা নীল নদীর কিনারা ধরে চালোকিত নীল রাত্রিতে আমারনা থেকে এলিফেনটাইন দুর্গের দিকে অশ্ব ধাবিত হয়েছিল। জানি না, এবারে ভাগ্যে কী আছে? ভাবল রিবিকা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
নদীর তীরভূমিতে দুই পারে নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। কারিগর, শ্রমিক, পাথর কাটিয়েদের বাসস্থান। আর আছে দু’ চারজন চাষী। সবাই বিদেশী। প্রায় সকলকেই সাদইদ দূর-দূরান্তর থেকে, বিধ্বস্ত নগরী থেকে সংগ্রহ করেছে। একবার ভাবল, এখানেই কোথাও আশ্রয় নেয়।
হঠাৎ সাদইদ আশ্চর্য প্রশ্ন করল–তুমি কী রূপে বাঁচতে চাও রিবিকা!
–মানে? তোমার কথা বুঝলাম না!
–মানে আর কী? অশেষ তোমার রূপ! দেবী-রূপে বাঁচবে, নাকি মানুষ রূপে বাঁচবে। আমি তোমাকে, যা চাইবে তাই করব! হেরা তোমাকে তেমন করেই আকৃতি দেবে!
রিবিকা চুপ করে রইল। সহসা অদ্ভুত একটি মাটির সুউচ্চ মূর্তি চোখে পড়ল। একজন অশ্বারোহী মরুভূমির উপর দিয়ে তীর-বেগে ছুটছে। অবাক করার মত। এই মূর্তিটাই এখন অবধি বৃহৎ। তাতে লেখা আছে–এই রাস্তা স্বর্গের দিকে গেছে! অশ্বারোহীর তীক্ষ্ণ বর্শার গায়ে অক্ষরগুলি আঁকা।
–হেরা তোয়ের করেছে!
–হ্যাঁ রিবিকা! এসো লোটাকে আমরা স্পর্শ করি!
অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে সাদইদ মূর্তিটির তলায় নত হল। মূর্তির গায়ে হাত দেওয়া মাত্র সাদইদের বুক হাহাকার করে উঠল।
–লোটার ঘোড়াটিকে তুমি খুজবে না সাদইদ!
–না রিবিকা। আমি আর পাব না। মরুভূমির ভিতর চলে গেছে। এতক্ষণ বেঁচেও নেই। এই মূর্তিই আমার সম্বল। পরে এটা পাথর দিয়ে নির্মাণ করা হবে । চেয়ে দ্যাখো হুবহু সেই মুখ। সেই দেহ। সেই বলিষ্ঠতা। সেই উল্লাস! হেরার হৃদয় কী স্বচ্ছ!
আবার অশ্বারোহণ করল ওরা। নদীর বহু পথ অতিক্রম করে ঘোড়াসুদ্ধ ওরা ভেলায় চড়ে নদী পার হল। তারপর সাদইদ বলল–সামনে ওই যে। বাড়িগুলো দেখছ, এই গ্রামে আমি জন্মেছি। এখানে আমার কেউ চেনা থাকলেও তাকে যেমন আমি চিনতে পারব না, সেও আমায় পারবে না।
–এখানে কোথায় থাকবে তাহলে? –রিবিকা প্রশ্ন করল।
সাদইদ বলল–এই গ্রামে নিনিভের এক নৌকারিগর থাকে। খুবই বুড়ো হয়েছে। চোখে ভাল করে দেখতেও পায় না। ওর একটা আট-নয় বছরের নাতনি আছে। সংসারে আর কেউ নেই। সবাই যুদ্ধে বিনষ্ট হয়েছে। বুড়োর নাম মিশাল । নাতনির নাম বিদ্যা। এদের কাছে থাকবে তুমি। এদের একখানা উটমুখী নীল নৌকা আছে,ভারী মজবুত। সমুদ্রের উপর পর্যন্ত ঘোরে। বুড়ো আমার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ । মিশাল তোমায় ওই নৌকায় সমুদ্রের ভিতর লুকিয়ে রাখবে!
রিবিকা এই সময় ঈষৎ ফুঁপিয়ে উঠল। রাত্রি তখনও কিছুটা বাকি। হঠাৎ সে সামনে দেখতে পেল সমুদ্র। তার কান্না থেমে গেল। নদী পিছনে পড়ে রইল অনেক দূরে। গ্রামকে তারা অতিক্রম করে এসে সমুদ্র পেয়েছে। নীল নৌকাও চোখে পড়ল কিনারে । মিশাল রিবিকাকে নৌকায় তুলে নিয়ে বলল–সারগন! আমার হিফাজতে রইল, চিন্তা করবেন না।
ফেরার পথে নদী অতিক্রম করার পর অশ্বারোহী সাদইদ কারিগরদের কুটিরের পথ অতিক্রম করছিল। হঠাৎ ইহুদের মন্দ্র কণ্ঠস্বর শুনতে পেল–সেই মহামারী আর ধ্বংসের কথা মনে নেই আপনাদের? নদীর স্রোতের মত মানুষের রক্ত প্রবাহিত হয়েছিল পর্বত গহ্বরে, গিরিখাতে; উচ্চ ও সমতলভূমি আর পাহাড় রঞ্জিত হয়েছিল এমনভাবে, মনে হত যেন লোহিত কম্বল–আমার কাঁধের এই লাল কম্বল লক্ষ্য করুন! শিবিরাগ্নির মত জ্বালানো হয়েছিল পাশ্ববর্তী সমূহ জনপদ, আর খালের টাটকা পানীয় জলকে রূপান্তরিত করা হয়েছিল জলাভূমিতে। সুন্দর সব ফলের বাগানে ঝটিকার মত গিয়ে প্রবেশ করেছিল সৈন্যবাহিনী, দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল লৌহকুঠারের শব্দ ..একটি শস্যমঞ্জরীও তারা অক্ষত ছেড়ে দেয়নি। তারা কারা? এই সাদইদ সেই এক নির্মম সেনাধিপতি ছাড়া কেইবা ছিল? আপনারা কেন তার মত মানুষকে অনুসরণ করলেন! আপনারা ফিরে যান।