চোখ দুটি পাপড়ির মত খুলে যায়। সভয়ে রিবিকা দ্রুত উঠে বসে। কাপড় তুলে বুকের কাছে জড়ো করে। সাদইদ রিবিকাকে হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করার জন্য পাথরের উপর বসবার চেষ্টা করে। রিবিকা পাথর ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে–আমায় হেঁবে না সাদইদ।
–কেন রিবিকা!
–লোটার হৃদয় কষ্ট পাবে।
–লোটা নেই। ও মরে গেছে। লোটা আর ফিরবে না রিবিকা! এখানে কেউ নেই। চারিদিক নির্জন। দ্যাখো সেই চাঁদটা এখানেও এসেছে। এই উপত্যকা ছেড়ে চাঁদ আর কোথাও যাবে না। এখানেই আমাদের স্বর্গ মিবিকা!
–তা হয় না সাদইদ। চাঁদ যেমন মিথ্যা, স্বর্গও সত্য নয়। একমাত্র ইয়াহোর স্বৰ্গই সত্য সারগন। লোটা ফিরে আসবে। সমস্ত মরুভূমিতে সে আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। মানুষ আজ জেনেছে, লোটা মরে না। সে মরেছে ভাবলে পাপ হয়। তার জন্য অপেক্ষা করলে মানুষের পরমায়ু বৃদ্ধি পায়। আমি আজও বেঁচে আছি কেন? বলে দাও, কেন বেঁচে আছি! তার সঙ্গে আমার দেখা হবে। ও যে আমার জন্য খাদ্য আর বস্ত্র জোগাড় করতে গেছে সাদইদ।
–আমি তোমায় খাবার আর পোশাক দেব রিবিকা! তুমি তো আমারই ছিলে! মনে আছে জুম পাহাড়ের সেই রাত। সেই সকালবেলা! আমার এই লুঠ করা হাত দুটি দুর্বল নয় রিবিকা!
–লোটার হৃদয় কষ্ট পাবে সাদইদ! তুমি যদি এই নির্জন স্থানে আমার অসম্মান করো–পাপ হবে তোমার! লোটার পত্নীকে কেউ ছুঁতে পারে না। দেবতা পর্যন্ত তার ওপর কু দৃষ্টি ফেলতে পারে না। আমি চিরপবিত্র নারী! ছোবে না আমাকে। স্বর্গ একটা প্রতারণা। তুমি পাপী!
সাদইদ বিষঃ সুরে বলল–তোমার দেহ! আমি যদি প্রজাপতি হতে পারতাম, তুমি আমায় পাপের কথা তুলে এভাবে কষ্ট দিতে না! আমার কষ্টের কি কোন দাম নেই? আমি নোহের সন্তান। কবি আমি। মনে নেই? আমি তোমাকে একটি ফুলের বিনিময়ে খরিদ করতে পারি। পারি না? এই নাও রিবিকা। অন্তত তুমি আমায় ফুলের পাপড়ি দিয়ে স্পর্শ করতে দাও।
হাতে ধরা ফুলটি সাদইদ সামনে এগিয়ে ধরে। বলে–এই ফুল নিশিগন্ধা । সাদা এর কলিকা। এখানে মধু আর শিশির জমেছে রিবিকা। এই রাতে একটি উটের চোখের জল এভাবে ঝরে পড়ে।
–ওভাবে বলল না সাদইদ! আমি আশ্রয়চ্যুত হব । আমার কেউ নেই যে সারগন! এই মাটিতে আমার জন্ম। তিনটি ভেড়ার বদলে আমি এখান থেকে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলাম এক বণিকের হাতে। ঠাকুমা বলেছিল আমার কাকারা ফসল ভাল হলে উট নিয়ে যাবে আমায় ফিরিয়ে আনতে। সেই অপেক্ষা করছি কত বছর। ওরা যায়নি ফরাতের বস্তীতে। কেউ নেই। এখানে এলাম। কেউ আমায় চিনল না। দেবদাসীকে কেউ চিনতে চায় না। মনেও রাখে না। তুমি ভুলে যেও সাদইদ। এই স্বর্গ আমার জন্য নয়। স্বৰ্গ কি কখনও নেমে আসে?
–আসে না? তোমার এই দাঁড়িয়ে থাকা কি সত্য নয়? –সাদই অবাক হল, গলায় অদ্ভুত কাতরতা।
–এ অলীক! সাজোয়ার মৃতদেহের ভিতর আমার এই দেহ কি শুয়ে থাকতে পারে না? পারে, খুব পারে! মনে করো, আমি নেই। অদৃশ্য জগৎ আমায় ডেকে নিয়েছে! বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠল রিবিকা।
এই সময় সাদইদের হাত থেকে নিশিগন্ধার কলিকা স্খলিত হয়ে রিবিকার পায়ের উপর পড়ে যায়। ফুলের স্পর্শে রিবিকার তামাম দেহ রোমাঞ্চিত হয়। মুহূর্তে তার দু’চোখ মুদে আসে। নাকের গোড়া স্ফীত হয়, বুকের ভিতর ঘন মদির খাস যেন ঢুকে যায়। ধীরে ধীরে নারীর দেহ কেঁপে ওঠে ঠোঁটের উপর ঘাম জমে।
সাদইদ রিবিকাকে স্পর্শ করবার জন্য হাত বাড়াতে গিয়ে বসে পড়ে পায়ের কাছে। ফুলের দীর্ঘ কলিকা তুলে নিতে গিয়ে দুটি হাতের তালু প্রসারিত উপুড় করে পায়ের উপর চেপে ধরে। রিবিকা গলায় অদ্ভুত সুখ আর কাতরতার মিশ্র ধ্বনি উচ্চকিত করে। তারপর সে সাদইদের মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকে শরীরে চেপে ধরে।
এমন সময় কালো অশ্বের হ্রেষা তীব্র মন্থনে গলার শিরা ছিঁড়ে আকাশে দীর্ণ হয়। পাগলের মত ছুটে আসতে থাকে ঘোড়াটা। কী যে হয় ঘোড়া ফের ফিরে যায় নিচের দিকে। অশ্বের এত আর্তনাদ কখনও শোনা যায়নি।
সাদইদ রিবিকাকে পাথরের উপর শুইয়ে দেয়। জ্যোৎস্না আরো উজ্জ্বল হয়েছে। ডালের দু’বাহুর ফাঁকে ঝুলছে মধুচক্র, মৌমাছির জ্যোৎস্নার মাদকতায় অদ্ভুত নড়াচড়া। চকচক করছে কালো পুঞ্জীভূত দেহগুলি। সাদইদ ভাবল, মধু যেমন সঞ্চিত থাকে মধুচক্রে, এই স্বর্গস্থানে সঞ্চিত থাকবে খাদ্য, পানীয় আর পোশাক। দুর্ভিক্ষে, বন্যায়, অভাবে মানুষ এখানে আশ্রয় পাবে। বন্যার জল নেমে গেলে, বর্ষার জল মাটিতে পড়লে, শীত অথবা গ্রীষ্ম কমে গেলে মানুষ নিচে নামবে।
কিন্তু নোহের নৌকাকে যেমন সেদিন মানুষ বিশ্বাস করতে চায়নি, তার স্বর্গকেও কেউ বিশ্বাস করবে না। এই রিবিকা স্বর্গ বিশ্বাস করে না। তাকে বোঝানো দরকার, স্বর্গ আকাশে থাকে এ ধারণামাত্র। সেই কল্পনা সত্য। কিন্তু এই মর্তে তার বিশ্ব মিথ্যা নয়। নারীর এই রূপ যেমন সত্য, স্বর্গও সত্য। স্বর্গ ছাড়া, হেরার ভাস্কর্য ছাড়া এ নারীর রূপ কোথাও বিম্বিত হতে পারে না।
অশ্ব আর্তনাদ করে উঠল। সাদইদ রিবিকাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে ফেলল। রিবিকা কেঁদে উঠল। দু হাত জড়ো করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল–হায় ইয়াহো। এ পাপীকে রক্ষা করো প্রভু!
কালো অশ্ব তীর এবং বর্শাবিদ্ধ হয়েছে। কে তাকে মারছে কেউ জানে না। অশ্ব ছুটে এসে পাগলের মত সাইদের গা ঘেঁষে আছাড় খেয়ে পড়ল, তারপর গা ঝাড়া দিয়ে প্রাণপণে উঠে দাঁড়াল।