–আমার আছে নিনি! আর্তস্বর ফুটে বার হয় সাদইদের কণ্ঠে । তারপর সাদইদ আকাশে চোখ তুলে বলে–আমার পাপ করার অধিকার আছে নিনি! নিশ্চয়ই আছে। দেবদাসী রুহা! তুমি শুনে রাখো, আমি পাপী! আমার কুড়িয়ে পাওয়া নারীতে আমার পাপেরই অধিকার মহাত্মা ইহুদ! এ নারী লোটার নয়।
এই নিথর, জ্যোৎস্নাপ্লাবিত প্রকৃতি সাদইদের কথায় বিচলিত হল না! কিছুক্ষণ বাদে একলা কালো ঘোড়াটা ফিরে এল। অনেকদিনই এরকম হয়, সাদইদ সাদা ঘোড়ায় চলেছে সম্মুখে, পিছনে ছুটে আসছে লোটার কৃষ্ণ অশ্ব। অকারণ কালো ঘোড়া অসহায়ের মত, অবাধ্যের মত দৌড়য়। তাকে ফেরানো যায় না।
কালো অশটিকে দেখে ভয়ে সাদইদ একটা বোবা আর্তনাদ করে কেঁদে ফেলে। সাদা ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে উঠে পড়ে। ছুটিয়ে দেয় ক্ষিপ্র বেগে। কালোটি তাকে অনুসরণ করে। সাদইদকে এক আশ্চর্য পাগলামি পেয়ে বসে। এই জ্যোৎস্নায় দেবদেবীর রমণকৃত সুঘ্রাণ হাওয়ায় ছড়ানো। পশুরা ঘুমাতে পারছে না। নদীর জলে সোনালী একটি সিংহী চকচক শব্দে জল পান করছে। জ্যোৎস্নার তীব্র দোলনে জল কাঁপছে সাদা ইস্পাতের ঢালের মত। সিংহীর নধর শরীরে কামনার কাপুনি। অশ্ব ছুটে যায়। রাত্রি বেড়েছে ঢের।
তাঁবুর পৃথিবী চোখে পড়ে। সাদা অশ্ব এসে থামে দিনারের তাবুর সামনে। কালো অশ্ব মুখ তুলে শূন্যে ভেসে বেড়ায় নিরুপায় অর্থহীন। দিনার বেরিয়ে আসে চুপচাপ।
সাদইদ বলে–তুমি কাল রাস্তা তৈরির কাজে নিয়োগ হলে দিনার। কাল আমার সঙ্গে দেখা করো। যাও রিবিকাকে ডেকে দাও।
দিনার প্রথমে সাদইদের প্রস্তাব বুঝতে পারে না। কাজে সে নিয়োজিত হবে কোথায়? আর কেনই বা রিবিকাকে ডেকে দেবে? কাজ এবং ডেকে দেওয়ার মধ্যে সম্পর্ক কোথায়!
দিনার চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বিরক্ত হয়ে সাদইদ বলল–শুনতে পাও না?
একটুখানি কেঁপে উঠল দিনার। তারপর জুমপাহাড়ী ভাষায় দিনার জবাব দিল–আপনার জিভ খসে পড়বে সারগন! কাকে ডাকতে বলছেন আপনি। উনি আমাদের মায়ের মত। সবার মা! আর আমাকে কাজের লোভ দেখাবেন না! আপনি তো ইয়াহোর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। যার কিনা হিতেন রাজার বিরুদ্ধে একটা কথা বলার সাহস নেই, সে বানাবে জিগুরাত! ওই কাজে আমাদের দয়া করে ডাকবেন না। থুঃ! কী ভাষায় কথা বলছি হায় ইয়াহো! যান চলে যান!
দিনার চলে গেল! কালো অশ্ব তীব্র আর্তনাদে আকাশে গলা তুলল। রিবিকার ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল, লোটা যেন এসেছেন! রিবিকা পাগলের মত বাইরে বেরিয়ে চলে আসে। সাদইদ ওকে হাত ধরে অশ্বে টেনে তুলে নেয়। তারপর অশ্ব আর থামে না। রিবিকার ঘোর কাটতে সময় লাগে না।
সাদইদ রিবিকার কানের কাছে মুখ রেখে বলে–বলেছিলে ভয় পেও না!
–আমায় ছেড়ে দাও সাদইদ!
–কেন তুমি বেরিয়ে এলে!
–আমার যে মনে হল, উনি এসেছেন!
–আমি সাদইদ রিবিকা! তোমার সারগন!
–অ। তুমি?
পাগলের মত কথা বলে রিবিকা। তারপর সাদইদের কোলে মূৰ্ছা যায়। অশ্ব কোথায় এসে পৌঁছয়, সাদইদ ছাড়া কেউ জানে না। এক আশ্চর্য উপত্যকায় উঠে এসেছে জ্যোৎআফেননিভ অশ্ব। স্বর্গের আলোয় জ্বলছে তার দেহ।
এমন সুন্দর উপত্যকা সাদইদের স্বপ্নের ভূমি। এ উচ্চস্থান ঝর্নার ধারায় সিক্ত, প্রকৃতিই নিজে সেজে রয়েছে, সমতল থেকে ধীরে ধীরে খাড়া হয়ে পাহাড়ের গা অবধি প্রসারিত হয়েছে এ পাহাড়ে ইয়াহোর অগ্নিচক্ষু আকাশ রক্তাক্ত করে না। এখানে ঝর্নাটি বাতাসে যেন দেবদাসী রিবিকার মাথার নীল ফিতার মত ভাসছে, অনন্ত সুরে বইছে, ফেনাইত হচ্ছে স্ফটিক বুদ্বুদ, নীল আভা-মাখা স্রোতে মিশে আছে কিঞ্চিৎ গেরুয়া পলি। এখানে আপনা-আপনি জন্মেছে দ্রাক্ষাকুঞ্জ, গাছপালাগুলি ঝুলিয়ে রেখেছে ফল ফুল মধুচক্র আর লতানো দোলনা। এখানে কখনও ভূমিকম্প হয় না। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে না ভয়ংকর পাগলা পাথর। এখানে গাছের ডালের দুবাহু তোলা ফাঁকে মুখ রেখে বসে থাকে পূর্ণিমা। লাল আলোর ঘোর আর ছায়া-মাখা চাঁদটি ফর্সা হয়ে ওঠে ক্রমশ। চাঁদটা একটা বিশাল মধুচক্রের ঝুলন্ত শিলার পাশে উঁকি দিয়ে ডালের দু’বাহুর উপর ধীরে ধীরে খাড়া হয়।
সেই ছায়া, সেই আলো, সেই শুভ্রতা রিবিকারসংজ্ঞাহারা মুখে এসে লাগে। চুলে এসে ঝর্নার বাতাস সুরের দোলা দিয়ে একটা তরঙ্গ উদ্বেলিত করে। রিবিকার বুকের কাপড় বাতাস যেন আকুল হয়ে অতি সন্তর্পণে খসিয়ে দিয়ে চলে যায়। পাথরে শায়িতা রিবিকা। চোখ মুদিত। হাত দুটির একটি মাথার দিকে এলিয়ে শ্লথ আবেশে পড়ে রয়েছে। অন্য হাতটি পাথর ছাড়িয়ে শূন্যে ঝুলে পড়েছে। নাভিমূলের একটি-দুটি রেখার নিচে কাপড় বিস্রস্ত। একটি পা পাথরের উপর সটান, অন্যটি পাথর গড়িয়ে ঝুলছে। রিবিকা কি পড়ে যাবে?
রিবিকার মাথার কাছে ঝর্না এঁকেবেঁকে চলেছে মেসোপটেমিয়ার খালের মত। যেন সুরই এঁকেবেঁকে গেছে। এই অবস্থায় আকাশের দেবতারা যেন চাঁদের মশাল তুলে রিবিকার মুখ দেখছে। দেবতারা এই রাতে মানবীর গর্ভসঞ্চার করে। তারপর তারা আর আকাশে ফিরে যেতে পারে না। তারা প্রজাপতি হয়ে পৃথিবীতে থেকে যায়।
হঠাৎ সাদইদের ভয় হয়, রিবিকা যদি আর না জেগে ওঠে? লোটার মতই যদি ঘুমিয়ে পড়ে? সাদইদ রিবিকার মাথায় হাত রাখে। রিবিকার দেহ নড়ে ওঠে।