–কিন্তু ইয়াহোর নিয়মটা তাহলে আমাকে বলবে! ইহুদ কেন এই নিয়ম রদ করতে চাইলেন? শোন বলি, মসীহ পশুদের চালনা করেন। চাষী পশুদের খেতে দেয়, বাঁচায়, চালিয়ে নিয়ে ফেরে। তাই মানুষ কখনও পশু হতে পারে না। চালকের বেঁচে থাকা দরকার। লোটার মৃত্যু তাই মেনে নেওয়া যায় না। সে পশুদের চালিত করেছিল। তুমি একটা অন্ধকার সময়ের কথা বলছ–এখন মানুষ হত্যা করা অন্যায়। আমি কিছুতেই তা হতে দেব না। যা আমার কবিতার সমর্থন পাবে না তাকে আমি উচ্ছেদ করতে চাই। কুমারীর রক্ত নয়, জমি উর্বর হয় পলিজলে।
–পলিজল!
–হ্যাঁ, পলিজল! এটা মাটির নিয়ম। সে উর্বর হওয়ার জন্য মানুষের রক্ত প্রত্যাশা করে না। সে চায় মাটিরই প্রলেপ। মাটি আপন নিয়মে কাজ করছে। জল তার আপন নিয়মে পলি বইছে। এই নিয়ম নিরন্তর চলছে। মানুষ এদিকে সে নিয়ম না জেনে নরবলি দিচ্ছে, কুমারীর দেহ কেটে ফেলছে। এদিকে মহাত্মা ইহুদ করলেন কি,মাথার উপর লাঠি ঘুরিয়ে বললেন–লাঠিই শ্রেষ্ঠ! পশুকে শাসন করে। হেদিয়ে মরছেন তিনি। এ করে হয় না হেরা!
–হয়, তা কে বলেছে!
–আমি নিয়ম না জানতে পারি, তাই বলে কুমারী মেয়েটি অকারণ হত্যা হয়ে গেল, তারা মৃতদেহ হিঁচড়ে টানছে মাঠের উপর দিয়ে–হৃদয় যদি তোমার দুঃখ না পায়, তুমি কখনও জল, বৃক্ষ, মাটির কথা বুঝতেও পারবে না–স্বর্গও তৈরি হবে না তোমার হাতে। নোহ নিয়ম জানতেন। তাই কিস্তি তৈরি হল। তিনি জল এবং মাটির কাছেই থাকতে চেয়েছেন। জলের উপর ভাসছেন। কিনারা খুঁজছেন। যিনি নৌকা তৈরি করবেন, তার কিন্তু লাঠি ঘোরানোর সময় হবে না। কারণ নৌকায় তাকে তুলে রাখতে হবে সকল জীব এবং বীজের নমুনা। একটা কালো খর্ব হাবসী কন্যাও যেন আমার স্বর্গে আশ্রয় পায় হেরা! কখনও যেন নিনিভার আর্তনাদ আর শুনতে না হয়!
–কিন্তু নৌকায়, তো সবাই আশ্রয় পায়নি। যারা পাপী তারা ঠাই পায় না। তারা মরে! নোহ তাদেরই নিয়েছিলেন, যারা পুণ্য করেছিল। আমি ইহুদের বক্তৃতায় একথা গত কদিন আগে শুনে এসেছি। তিনি আমায় দেখে বললেন, ওহে কর্মকার–কী ব্যঙ্গ ভাবো–বললেন, আর কী সব বানাচ্ছো এখন বললাম–নোহর কিস্তি মহাত্মা! তা উনি শুধালেন–কার জন্য! কথাটা অত্যন্ত বাকা–একেবারে হৃদয়ে এসে বেঁধে! বললাম, তেমন বাছবিচার করিনি মসীহ! তা উনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন–তবে এ নৌকা তোমার তলিয়ে যেতে বাধ্য হেরা! বাকি কথা তোমায় আর বলতে পারব না। সাদইদ!–চুপ করে গেল হেরা!
সাদইদ চেয়েছিল গমের ঝাড়ালো শিষগুলির দিকে। ভাবছিল মধু আর রুটি আর ডুমুর। খোবানী-খেজুর! মানুষ খাবে। মাটি এবার প্রচুর দিয়েছে। গমগাছের গোড়ায় জল জ্যোৎস্নালোকে চিকচিক করছে। সেই ঝিলিমিলি অসম্ভব সুন্দর! চেয়ে থাকলে নিশ্চয় পুণ্য হয়। হঠাৎ পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে সাদইদ বলল–লোটা তবে কী পাপ করেছিল হেরা! মরল নে?
হেরা বলল-লোটা তো মরেনি!
–মরেনি?–সাদইদ কাতর স্বরে এক তীব্র আর্তনাদ করে।
–না। ইহুদের উম্মতরা লোটার মৃত্যুর কথা বিশ্বাস করে না। এই মিথ্যা প্রচারের জন্য তোমাকে ঘৃণা করে! পুণ্যবান লোটার কখনও মৃত্যু হতে পারে না। তারা বিশ্বাস করে লোটা একদিন ফিরে আসবে।
–অসম্ভব!
–সে তত তোমার আমার কাছে সাদইদ। ইহুদের উম্মতরা মনে করে, লোটা মরুভূমিতে রয়েছে। নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। ফলে লোটার স্ত্রীর আর কখনও বিয়ে হবে না। রিবিকাকে আমি কখনও দেখিনি। নিশ্চয়ই সে নিনিভার মত বোবা। রিবিকা নিশ্চয়ই দেবীর মত সুন্দর। লোটা ছাড়া তাকে কেউ কখনও স্পর্শ করতে পারবে না। ভেবে দ্যাখো সাদইদ, সামনের ওই কালো ঘোড়াটা কী মিথ্যা হয়ে গেল!
–এসব কথা তোমার মুখে আমি আর শুনতে চাইনে হেরা! তুমি ফিরে যাও! আমার ফিরতে দেরি হবে।
–এখানে কী করবে এখন?
–লোটার জন্য অপেক্ষা করব!
–পাগল! তুমি কী পাগল হয়ে গেলে! যা তুমি বিশ্বাস কর না, তার জন্য কি অপেক্ষা করা যায়!
–একটি মেয়ে কী করে পারে!
–পারে না সাদইদ, পারে না!
পারে, কে বলেছে তোমায়? পারা উচিত নয়।
–উচিত নয়? তবে সে রয়েছে কী করে?
–সে তো আমি বলতে পারব না।
–তবে তুমি কথা বলছ কেন হেরা! কেন বলছ কথা!
প্রায় চিৎকার করে ফেলল সাদইদ। আর্ত সে স্বর গলায় হাহাকার করে উঠল। হেরা নিচু সুরে বলল–নিনিভার বোন মরল এই রাতে। কেন মরল, এতদিন যা জানতাম তা ভুল! কিন্তু রিবিকা যে অপেক্ষা করে রয়েছে একথা ভুল নয় সাদইদ। ভুল হতে পারে না। লোটা ফিরে এসে যুদ্ধ করবে।
–যুদ্ধ!
–হ্যাঁ। ইহুদের সাম্রাজ্য গড়ে উঠবে সেদিন।
–কী বলছ তুমি?
–তুমি ইয়াহোর ধর্ম গ্রহণ করো সাদইদ! তুমি পাপী!
–এ পাপ কিসের হেরা!
–যুদ্ধের! লোটার অপমানের। লোটা ফিরে আসবে সেকথা বিশ্বাস না করার পাপ। তুমি তুচ্ছ একটা মানুষ সাদইদ। কাফের! পাপ করার অধিকার তোমার আছে।
হঠাৎ মনে হল, এ যেন হেরা নয়, ইহুদেরই কণ্ঠস্বর। কালো অশ্বটি মুহূর্তে মিলিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। একা দাঁড়িয়ে রইল সাদইদ। ক্রমশ তার হৃদয়ে হেরার বলা কথাগুলি চেপে বসতে লাগল। তুমি একটা তুচ্ছ মানুষ। পাপ করার অধিকার তোমার আছে।
নিনিভার কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল–সবার কত কিছু আছে। তোমার নেই কেন? তোমার শিশু! তোমার নারী!