–তাহলে তোমার শিশু কোথায় সারগন!
সাদইদ সেই জবাব না দিয়ে বলল–ইয়াহোর স্বর্গ–ইহুদের বেহেশ্ত অসম্পূর্ণ হেরা! অথচ ইহুদের কিছু কল্পনা আমার মন্দ লাগে না। ওঁর ওপর ইয়াহো যখন ভর করেন, তখন বেচারি স্বর্গের বিবরণ দেন–যেন তিনি স্বর্গের সকল আকৃতি দেখতে পাচ্ছেন? সেই বর্ণনায় কখনও শুনিনি যে,তিনি দেখছেন #কটি উটের পিঠে একটি শিশুর জন্ম হচ্ছে! আমার কথা হেরা তুমি বুঝবে না!
উটের পিঠে জন্ম, উটের পিঠেই মৃত্যু-একঘেয়ে ধূসর মরুপথ–তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে–উটকেই অতঃপর হত্যা করে জলের থলি টেনে বার করে তেষ্টা মেটানো-মরুভূমি এমন মানুষকেও বাঁচিয়ে রাখে। আর যেখানে মানুষ বৃক্ষের স্বভাব পায়–নদী পায়–উপত্যকা পায়–সেখানেও বৃষ্টির জন্য কুমারী বলি দিয়ে রক্তাক্ত নারীদেহ ফসলের মাঠে টেনে নিয়ে ফেরে। একটা কুমারী দেহ, জল্লাদ কেটে ফেলে দিলে তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়–কার জমি কুমারীর রক্তের ছোঁয়া পাবে! ফসল ভাল হবে। যুদ্ধের পর নারীর সংখ্যা বাড়ে পুরুষের তুলনায়, কুমারী বলি থাকলে সেটা ফের সমতায় ফিরে আসে। এই কি জীবন?
মানুষ এভাবে কতকগুলি নিয়ম চালু করে। কুমারী বলি রদ করেছেন মহাত্মা ইহুল। কিন্তু বৃষ্টির জন্য দেবদেবীর দেহমিলনের অভিনয় হয় নববর্ষে–সেটা এখনও রদ হয়নি। শুধু একটা লাঠি ঘুরিয়ে তাঁকে সমস্ত কাজ করতে হচ্ছে। হলে আকাশে মাথার উপর লাঠি ঘুরিয়ে তাঁকে চিৎকার করে বলতে হচ্ছে, কুমারী বলি অতি দূর দূরান্তরের দেশের, মহুলা নদীর পারের ঘটনা—হাল আমলে এখানকার পুরুতরা চালু করেছিল–জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য তারা নানারকম পূজা চালু করছে–যার কখনও নামই শোনা যায়নি। আর একবার একটা জিনিস চালু হলে সহজে রদ করা যায় না। নতুন একটা নিনিভে-পূজাও চালু হয়েছে। মড়ক-পূজার নতুন নাম হয়েছে নিনিবে। মারীর দেবী নিনিবে।
অথচ হেরাকে ধন্যবাদ যে, সে তার স্ত্রীর নামই রেখে দিলে নিনিভা। তার সংস্কারে বাধলও না একটু। ভয়ও করল না! আতঙ্ককে ভালবাসার মধ্যে হেরা মজা পায়। লোটার কথায় তার দুচোখ ঢেকে ফেলার ভয় বোধহয় ভয় নয়–কান্না। এই ছবি তার হৃদয়ে ঢুকে গেল। সারাদিন, সারাজীবন হেরা ওই দৃশ্যটা ভুলবে না। ক্রমান্বয়ে সে ভাববে।
বছর চৌদ্দ বয়েস নিনিভার। বলির মুখ থেকে বেঁচেছে সে, তারপর বোবা হয়ে যায়। নিনিভা যদি বোবা না হত, তাহলে হয়ত হেরা তার কাছে ছুটে যেত না। হেরা এরকমই।
সাদা অশ্বটার পিঠে লাফিয়ে উঠল সাদইদ। প্রবল জ্যোৎস্নার ভিতর ছুটতে শুরু করল।
নদীর বাঁধটার কাছে এসে ঘোড়ার পিঠে শান্ত হয়ে দাঁড়াল সাদইদ। জল ফেঁপে উঠে খালে গিয়ে পড়ছে। মাটির উপর পলি জমলে মাটি উর্বর হয়–মেসোপটেমিয়া তার নদীর তীরে এই নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছিল। সেখানকার চাষীদের দক্ষিণ এলাকা থেকে, মারীর বিভীষিকার কবল থেকে টেনে এনেছে সাদইদ–এখানকার লোকেরা ভয়ে শুকিয়ে কাটা হয়ে গিয়েছিল। নদীর এই দূরবর্তী এলাকায় তাদের ঘর বেঁধে দিয়েছে সাদইদ। এরা বাধ বেঁধেছে, খাল কেটেছে। এমন ফসলের রূপ কনান কখনও দেখেনি। শস্য পাবার সময় হয়ে এল। সেই গন্ধ নাকে এসে লাগছে।
জ্যোৎস্নায় চারিদিক নিথর। হঠাৎ দূরে মাঠের ভিতর মশালের আলো চোখে পড়ল। তারপর সমবেত বিচিত্র চিৎকার। ঘোড়া ছোেটালো সাদইদ। কাছাকাছি যেতেই দেখা গেল কতকগুলি লোক মাঠের উপর দিয়ে কী যেন বস্তু দারুণ উল্লাসে মাতলামো করতে করতে টেনে নিয়ে চলেছে, চিল্কারে আকাশ ফাটিয়ে তুলছে। অষের পায়ের শব্দ শুনে লোকগুলি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর কে একজন চেঁচালো–সারগন! ওরে সারগনের ঘোড়া! চ! ফেলে দে! আর নিয়ে যেতে হবে না। অ্যাই! সর্বনাশ হল! পালা, পালা!
মাঠের উপর মশাল ফেলে দিয়ে যে যেদিকে পারল ছুটে পালিয়ে গেল। অশ্বের পিঠ থেকে নেমে মাটিতে পড়ে থাকা জ্বলন্ত মশাল তুলে ঝুঁকে পড়ল সেই বস্তুটির উপর। সাদইদ দেখল–নিনিভা! কিন্তু তা কী করে সম্ভব! একটু আগেই তো সাদইদ নিনিভার সঙ্গে কথা বলে এসেছে। মুহূর্তে এ ঘটনা কী করে ঘটে! অবিকল নিনিভার মুখ।
সাদইদ অশ্ব ছুটিয়ে ফিরে আসে। এসে দেখতে পায় নিনিভা হেরার সঙ্গে কথা বলছে। অশ্ব থেকে নেমে এসে বলে-তোমার মত দেখতে এই গ্রামে আর কেউ আছে?
–হ্যাঁ। আমার বোন। দু’বছরের ছোট। আমার আরো পঁচটা বোন আছে। একজন দেখতে আমার মত। কেন?
–ও বলি হয়ে গিয়েছে নিনিভা। ইহুদের ভয়ে রাত্রে কেটেছে।
নিনিভা আর্তনাদ করল–জানতাম! বাবা বোনটাকে বাঁচতে দেবে না। মাঠে ফসল হচ্ছে না বলে বলির জন্য বাবার কাছে পুরুত আমাদের চাইত। হায় গোলাপী, শেষে তুই ..
বোনের নাম ধরে ডুকরাতে থাকল নিনিভা। অশ্ব ছুটিয়ে এসে মাঠের মধ্যে গোলাপীর বলি হওয়া মৃত গলা কাটা দেহ খুঁজে পেল না সাদইদ। হেরা কালো ঘোড়ায় চড়ে সাদইদের পিছু পিছু এসেছিল।
বলল–তোমার কি কষ্ট হচ্ছে সাদইদ? কতকগুলি নিয়ম তুমি বুঝতে চাও না কেন? তিনটে ভেড়ার বদলে হাটে একটা বালিকা খরিদ করা যায়। পশুবলি হলে নারী কেন বলি হবে না? তুমি একটা স্বাভাবিক ঘটনায় এত উত্তেজিত হও! তুমি কি ভাবছ, হাটে কেবল পশুই বিক্রি হবে, মানুষ বিক্রি হবে না? পশু আর মানুষে তফাত করাটা তোমার কবিত্ব হতে পারে, নিয়ম হতে পারে না।