হেরা বলল–তোমার কি মনে হয় না, যার যা ভাল লাগে সে সেই ধর্ম করবে! পূজাবিধি কতকালের অব্যেস! মূর্তি ছাড়া ধর্ম কী করে হবে! নগর কী করে হবে!
সাদইদ বলল–তোমার সেই এক কথা হেরা। নগর। নগরের সঙ্গে মূর্তির কী সম্বন্ধ!
–সম্বন্ধ আছে সাদইদ। ডানাঅলা বৃষ–নিনিভের ভাস্কর্য! মূর্তি ছাড়া তুমি তোমার শক্তি, সমৃদ্ধি, তোমার শৌর্য–কিছুই প্রকাশ করতে পারো না। মানুষ মূর্তিতে পরিণত না হলে দেবতা হতে পারে না। যেমন মিশরের ফেরাউন। মূর্তি যত বিশাল হবে মানুষও তত দেবতা হয়ে উঠবে। নতুবা দেহটা হবে সিংহের, মাথা হবে মানুষের–অন্তত তুমি তাই হও–আতঙ্কের জনক। তোমার পায়ের তলায় পিঁপড়ের সমান পড়ে থাকবে চাষা। একজন মুটে। একজন কারিগর। একজন ঘরামী।
–তাহলে বলছ, মূর্তিই সব?
–মূর্তিই সব সাদইদ। নগর মানে মূর্তি। বিশাল মূর্তি। বড় বড় রাস্তা। রাস্তার উপর মূর্তি। কোন উচ্চতার উপর মূর্তি। যাতে ভয় আর সম্ভ্রম হয়। উচ্চতা, কেবল উচ্চতা। ক্রমাগত উচ্চতার দিকে ওঠা। পিরামিড একটি সুউচ্চ আকৃতি–একটা জ্যামিতি ছাড়া কিছু নয়। এর কি কোন মানে নেই? নগর। বলতে কতকগুলি সুউচ্চ বিশাল আকৃতিকে বোঝায়। মিনারকে বোঝায়। সৌধ বোঝায়। স্তূপ। জিরাত। স্বর্গ! এইসব বোঝায়।
–কিন্তু স্বর্গ বোঝায় না হেরা!
দু’জনের উত্তেজিত তর্কে নিনিভা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এমন অভিজ্ঞতা তার কখনওই ছিল না। বাচ্চাকে সে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরেছে সবেগে।
হেরা অবাক হয়ে বলল–স্বর্গ বোঝায় না?
সাদইদের গভীর জবাব–না।
একটু থেমে বলল–বোঝায় না। মধুদুগ্ধের দেশ এটি। সহিষ্ণু। সব ধর্ম এখানে থাকবে। কিন্তু মধু থাকে উচ্চে। মধুচক্র থাকে উপরে। কিন্তু তা টুপিয়ে পড়ে মাটিতে। গাভীর দুধ মাটিতেই ঝরে পড়তে চায়। উপরে থাকে এইজন্য। যে,তা মাটির উপর ঝরবে। উপরে থাকার নিয়মই হচ্ছে নিচে নামার উদ্দেশ্য। মধুদুগ্ধপ্ৰবাহিণী দেশ। মর্তের অমরাবতী। স্বর্গ উপর থেকে নিচে নামবে। তাড়া করে ওঠা নয়।
হেরা বিড়বিড় করে বলে–তাড়া করে ওঠা!
সাদইদ বলল–হ্যাঁ। একটা জ্যামিতির কথা তুমি প্রায়ই বল। তোমার সঙ্গে আমি একমত। তুমি ভাস্কর, স্থপতি, জ্যামিতি মানে যেমন ধরো তিনটে বাহু উপরে খাড়া হয়ে আকাশ ধরতে চায়। ত্রিভুজও তো একটি জ্যামিতি। কিন্তু সেটা আদৌতে কবর। হাত দিয়ে ছুঁতে না পারার ফলে পাথর সাজিয়ে সাজিয়ে বাহু বাড়ানো–এই আকৃতি সম্ভ্রম ঘটায়, কিন্তু একজন চাষীর দুঃখ বাড়িয়ে দেয়, পিঠ নুইয়ে দেয়। আমি বলছি, এভাবে তেড়ে ওঠাকে আমি সুন্দর বলি না। মধু টুপিয়ে মাটিতে পড়ছে, ফল মাটিতে পড়ছে, ফুলের ভারে ডাল নুইয়ে নামছে। হাওয়ায়। যত কিছু সুন্দর তা মাটির দিকে নামতে চায় কেন! সূর্যের আলো, চাঁদের আলো মাটির দিকে নেমে আসছে কেন? ইন্দ্রধনুটা নামতে পারছে না। বলে শান্ত জলের তলায় এসে ভাসছে। মেঘ নামছে বৃষ্টির হাত ধরে মাটিতে! তাহলে স্বর্গ কেন মাটিতে নামবে না! তোমার কী মনে হয়?
হেরা স্তব্ধ হয়ে চুপ করে গেল। নিনি অবাক হয়ে সাদইদের বুকের দিকে চাইল। ওখানে হৃদয় আছে। কিন্তু এতসব কথা হৃদয় চিন্তা করতে পারে । চিন্তার ধকলে এই মানুষটি মরে যাবে না তো! ফের হেরাও তর্ক বাধানোর জন্য। দম ধরেছে। দুটিই পাগল।
হেরা বললনগর না গড়লে তুমি কিছুতেই স্বর্গ গড়তে পারো না। মধু যে মাটিতে টুপিয়ে পড়বে তার জন্য মধুচক্র দরকার। উচ্চতা দরকার। বন্যা যাতে তোমাকে ঘিরে না ধরে। দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধ যেন তোমাকে তেড়ে না মারে। গ্রামগুলির দিকে যদি তুমি নজরদারি করতে চাও, তোমাকে উচ্চতার দিকে যেতেই হবে।
সাদইদ বলল–হ্যাঁ, গ্রামগুলির দিকে নজর রাখা। উপরের দিকে ওঠা এই জন্য যে, যেন আমি নিচের শেষ অবস্থাটা, একেবারে তলার স্তর দেখতে পাই। যেখানে লোটা মুখ গুজড়ে পড়ে রয়েছে!
হেরা চমকে উঠল। অবাক হয়ে সাদইদের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। সাদইদ অতঃপর ম্লান হেসে বলল–মূর্তি আমার চাই। লোটা মুখ খুঁজড়ে মরুভূমির বালিতে পড়ে আছে, তার কাছাকাছি ছড়িয়ে রয়েছে পশুগুলি-মরু আকাশ থেকে নেমে আসছে নখরঅলা ভয়ংকর কালো ঈগল। এই মূর্তিটা আমার চাই হেরা! একজন নিঃসঙ্গ পড়ে থাকা হাঁটু ভেঙে পড়া মানুষ–অথচ নির্দয় আকাশ, মরু ঈগল!
–ও হো হো! অমন করে বলল না সাদইদ–সহ্য হয় না!
ভয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে হেরা। নিনিভা নরম লাবণ্যময় শ্যামা-উজ্জ্বল মুখ ভয়ে বিস্ময়ে ভরিয়ে তোলে, দুচোখে তার টলটল করে কাঁচা শিশুগম চারার মত আলো। স্নিগ্ধ করুণ চির হরিতের মুগ্ধতা নিনিভাকে কখনও যেন ছেড়ে যাবে না মনে হয়।
–একজন মানুষ ভালবাসে কতকগুলি আকৃতি-নারী তার মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আকৃতি–স্বর্গ মানে চির বসন্তের আলোপগ্ন নারী আর নগ্ন শিশুর চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। সেই আলোর মধ্যে নারী আর শিশুরা থাকে। হেরা! আমি আর কিছু চাই না!
–কিন্তু তোমার সেই নারী কোথায় সারগন!–নিনিভা শুধালো।
সেকথার জবাব না দিয়ে সাদইদ বলল-ইয়াহোর স্বর্গে শুধু নারী থাকে। পুরুষ আর নারীর অবিচ্ছিন্ন ক্লান্তিহীন মিলন। সেখানে শিশু নেই। স্বর্গের দেওয়ালে তুমি একেছ একটি স্রোত। গাভী আর বৃষের তুমুল প্রবাহ। সন্ধ্যা হয়ে আসছে-দেবতা আমন আকাশে ডুবুডুবু, যাই যাই করছে। পশুর গলায় ঘণ্টা বাজছে। সেই একটা স্রোত চলেছে তো চলেইছে। ভেবে দ্যাখো হেরা! সেই দলটির মধ্যে তুমি একটা শিশু; সাদা ধপধপে বাছুর দাওনি! আমি তাহলে তোমাকে স্বর্গের সেই দেওয়ালটি ভেঙে ফেলতে বলব।