ইহুদ বললেন–সবুরে মেওয়া ফলে মা!
–হ্যাঁ খোবানী জন্মায়! কিন্তু গাছ তো পুঁতবেন!
–ইয়াহো ধর্মের উদ্ভিদ। তিনি তোমায় ছায়া দেবেন।
এই দৃশ্যের সামনে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। সাদইদ সরে চলে আসে। তাঁবুর এই পৃথিবীতে ঘুরতে ঘুরতে কত নির্মম ছবি চোখে পড়ে। সাদইদ দেখে এক নিঃসঙ্গ সৈনিককে–একা একটি পাথরের উপর বসে আছে। বয়স বেশি নয়। বেচারি মরুভূমির জাতক–যে কিনা উটের পিঠে প্রসবিত হয়েছিল। চাষী জীবনের সঙ্গে এর কখনওই কোন যোগাযোগ ঘটেনি। নাম দিনার। এ যেন সমেরু আর লোটার মিলিত প্রতিচ্ছায়া। বাপ-মাকে কোথায় হারিয়েছে। সে তার দেহ থেকে হিতেনের উল্কি মুছে ফেলেছে–সেই ক্ষতস্থানে চেয়ে ঘাড় গুঁজে চুপচাপ বসে থাকে।
–একা বসে আছো?
–হ্যাঁ।
আর কোন কথা বলল না। দু’ধরনের সৈনিক। এক যারা চাষী ছিল। জমি থেকে উৎখাত হয়ে ক্রীতদাস হয়। দ্বিতীয় যারা মরুভূমি থেকে ক্রীতদাস হয়ে পিরামিডে কাজ করত। পরে সৈনিক হয়েছে। পদাতিক। যারা চাষী ছিল তারা চাষে ঢুকবার চেষ্টা করছে। কিন্তু যারা পাথর বইত উটের পিঠে বা চাকাঅলা গাড়িতে, তারা চাষীদের চোখে ঘৃণ্য। এদের জন্য এই গ্রামে কোন কাজ নেই।
নতুন জামাতা হয়েছে যে সৈনিক, তার সঙ্গে শ্বশুরের সংলাপ কানে আসে।
–শ্যামাঘাস চেন বাপ? গম আর ঘাসে একাকার।
–চিনতে হবে!
–ওহ্! এখনও চিনতে হবে! কবে চাষবাস করতে মানিক!
এক ঝটকায় কানে এল কথা। শ্বশুর বলল–কত না জমি-জিরাত ছিল। মানিকের! খেজুরের বাগান! খোবানির চাষ। খেজুরের আঁটি যেন পিরামিডের পানা খাড়া হয়ে থাকত! গাইয়ের দুধে গোঁফ চুমরে যেত! আঁটি হত জ্বালানি আর দুধ হত ক্ষীর। একবার ফরাতের পলিতে আটকে গেল পাঁচখানা গাই, সেকি কাণ্ড! বাঁট ঠেকল কাদায়, দুধের ভারে থইথই! কাদায় গড়িয়ে পড়ে দুধ। কালো এটেল আর সাদা দুধ! সেই একটা জীবন ছিল বটে।
–আজ্ঞে!
–তবে মানিক আমার শ্যামাদাস চেনেন না!
–আজ্ঞে বিস্মরণ হয়েছে।
–তা তো হবেই, কতকালের কথা!
–আজ্ঞে!
–ওট্ শালা সেপাই! মিছে বলার আর জায়গা পেলে না। আরে যা যা, তাঁবুর ইস্তারীর কাছে যা! শরীরের কী ব্যাধি আছে, কে জানে ঘোড়াখোর! আমার মেয়েকে ভোগাভাগা দিয়ে এখন জমিতে দাগ বসাতে চাও! ওই যে কী বলে নাম, ইয়াহুদ, সেইটেই সব্বেনেশে! মহাত্মা বলে কথা!
এই অপমান হজম হয় না। তাঁবুতে অগত্যা জুমপাহাড়ীর স্ত্রীর কাছে ফেরে সেই লোক। কুটির থেকে নতুন কনে হামলায়। তাঁবুর বউ স্বামীকে পেয়ে বলে–সবুর আর কত করব সেপাই!
সেপাই ডাকটি শুনে মাথা গরম হয়ে যায়। দেবদাসীকে অকথ্য গাল দেয়। পিটিয়ে পাট পাট করে দেয় লোকটি।
দেবদাসী বিধবস্ত বাহু, পিঠ দেখিয়ে বলল–দেখুন সারগন! আপনি বলুন, মুক্তি কবে পাব? হে অদৃশ্য ঈশ্বর, তুমি কি দেখতে পাও না!
লোটার অশে ধাবিত সাদইদ আকাশে চোখ তুলল। আকাশে চাঁদের সভা বসেছে। তারকারা চাঁদের মুখপানে ঝুঁকে আছে। চাঁদ কথা বলছে, তারকারা শুনছে। একটা নীলাভ গোল বৃত্ত। কস্তুরী আভা জড়ানো যেন এক গোল তাঁবুর রাত। আজ প্রচুর বাঁচতে ইচ্ছে করে! কিন্তু বেদনা জাগে গম শিষ আর যব শিষের পার্থক্য বোঝে না বলে একজন সৈনিক যখন অপমানিত হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিশুকে চুম্বন করল সাদইদ। তারপর বলল–ওহে নিভা! ভাল করে আঁকড়ে থাকো পিছনে। পড়ে যেও না!
হেরা তার শিশুকে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। আরো আশ্চর্য নিভাকে দেখে। সাদইদের হাত দুখানি ধরে বললে–এমন কখনও হয় না সাদইদ! কখনওই হয় না। আমি আরো মূর্তি বানাব। পুরনো দেবদেবীদের অনেক ভাব আমার মাথায় এসেছে। এবার নববর্ষে মন্দিরে একেবারে মচ্ছব হবে। দেবদেবীদের অভিনয় করবে মানুষ। লিঙ্গপূজা হবে। কত কি হবে। নিনি আমার সঙ্গে থাকবে। ওর নাম কিন্তু নিভা নয় সাদইদ। ও নিনি। আমার স্বপ্ন।
–এ তোমার পাপের উপার্জন। এ তোমার দণ্ড হেরা। তুমি কখনওই আর মূর্তি বানাতে পারবে না। ইহুদের সঙ্গে শর্ত করে এসেছি। শিশু আর নারীর জন্য তোমায় শিল্পচর্চা ত্যাগ করতে হবে। যদি এই শর্ত অমান্য করো, তোমার আঙুল কর্তন করা হবে।
–অসম্ভব! এ হতে পারে না। হাস্যকর প্রস্তাব। মূর্তি না বানালে আমি খেতে পাব না। বাঁচতে পারব না। মাটি মানেই মূর্তি। মাটি তার রূপ চায়। পাথর তার রূপ চায়। পেত্তল তার রূপ চায়। সোনা চায় অপূর্ব রূপের কান্তি। নগর হল রূপের একটি উচ্চতা। নিনি আমার পাপের উপার্জন নয়। সে আমার অর্জন। একটা রূপের বদলে পেয়েছি। ও আমার বোবা দেবী, ওর সঙ্গে দেহ মিলনে কোন পাপ নেই আমার। আমায় বিরক্ত করো না! নিনিভা! ও নিনি! স্বপ্নের নগরী! হায়!
বলে শিশুকে কোলে করে নিনির হাত ধরে জ্যোৎস্নায় নেমে গেল হেরা। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সাদইদ। তারপর আশ্চর্য হয়ে হেসে ফেলল। হেরাই। পারে জীবনের একটা ভয়ানক সমস্যাকে মুহূর্তে মিটিয়ে ফেলতে।
এই হেরাই অতঃপর যোবা মেয়েটির মুখে ভাষা দিল। নিনি একদিন আশ্চর্য প্রশ্ন শুধালো-সবারই তো কিছু না কিছু রয়েছে। সারগনের কেউ নেই কেন?
হেরা সাদইদকে চোখের ইশারা করে বলল-এবার জবাব দাও!
সঙ্গে সঙ্গে সাদইদের চোখের সামনে ভেসে উঠল দিনারের মুখচ্ছবি। সে ঈষৎ হাসল। বলল–আমার অনেক আছে নিনিভা। তোমরা জানো না! তোমরা নতুন ঘর বাঁধলেনগর ধ্বংস হয়ে গেছে, তোমাদের দেখলে সেকথা মনেই হয় না! আগুন সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছ তোমরা ইহুদ ভেবেছিলেন তোমরা বিয়ের সময় তাঁর কাছে যাবে! এ তাঁর ব্যর্থতা!