রিবিক এগিয়ে এল সামনে! সাদইদের বলতে ইচ্ছে করল–এই নারীকে আমি চাই মহাত্মা ইহুদ। এর সঙ্গে আমার পাপের সম্বন্ধ!
কিছুই কিন্তু বলতে পারল না সাদইদ। কেবল রিবিকার বিমর্ষ আর গভীর চোখ দুটির দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বলল–কেমন আছে প্রজাপতি!
রিবিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-জানি না সারগন!
–শোন সাদইদ। লোটাকে আমি বাঁচাইনি। ইয়াহো বাঁচিয়েছিলেন! তোমার কথাই ঠিক। লোটা যদি না ফেরে কখনও, তবু এই সত্য স্থির থাকবে!
বললেন ইহুদ।
রিবিকা বলল-যুদ্ধ থেমেছে। তবু যুদ্ধ থামেনি সারগন। ভয় পেও না!
কালো অষের পিঠে ওরা তিনজন। শিশু, নিভা আর সাদই। এ এক আশ্চর্য অশ্বারোহণ। চকিতে অন্য এক দৃশ্য ভেসে উঠল রিবিকার মনে। সাদা অশ্ব ছিল। সেটি। কিন্তু আজকের অশটি তো কৃষ্ণকায়। মুহূর্তে ম্লান হয়ে আসে চোখ।
ভয় পেও না। যুদ্ধ থামেনি সারগন! আজ সাদইদের মনে হল, লোটা নেই, তবু তার অশ্ব আছে যেমন, তেমনি যুদ্ধও ফুরোয়নি। একদিন যুদ্ধ থামবে মনে হলে জীবনে আর কিছু বুঝি নেই, মনে হত! আজ মনে হচ্ছে, সব আছে তার। কিছুই হারায়নি। শুধু একটি শব্দ–ভয় পেও না। এ কী বিষম শক্তিধর। কুমারী বলি হয় যে দেশে, দেবী থাকেন নাঙা, বাবা মেয়ে ধর্ষিত হয়–সেই। দেশের নারীকণ্ঠে এত জোর থাকে কী করে! যুদ্ধ সব রূপ ভাঙে, আকৃতি ভাঙে, স্বর্গ ধ্বংস করে, ঈগল ওড়ায় আকাশে, যোদ্ধা ঘুমিয়ে পড়ে পথে, আর জাগে না, মরুশকুনের চোখ টলটল করে, সমেরু ঝোলে ডালে, তাঁবু আওয়াজ করে। ফটফটসু বহে, দুর্ভিক্ষ হয়, বান ডাকে, শোকে স্তব্ধ হয় পৃথিবী–তারপরও নারী বলে, ভয় পেও না। সামান্য চাষীকে, অতি তুচ্ছ যাযাবরকে, ভাড়াটে ফেরতা সৈনিককে ডাকে সারগন! সেই এক কোমল নারী ডেকে ওঠে, যাকে দুটি অদ্ভুত বর্ণবহুল ডানা কাঁপানো প্রজাপতি ফুল ভেবে অধিকার করেছিল! এ কী বিস্ময় ব্যাকুল চন্দ্রকলার দেশ। এ মরুমর্ত অশেষ শোকেও গান গায়!
হঠাৎ কতকাল পর আকাশে চোখ তুলে চাইল সাদইদ। মনেই ছিল না, মাথার’পর আকাশ রয়েছে। সেখানে চাঁদ আর নক্ষত্ররাজি ওঠে। তার একদা পাহাড় ছিল, তথায় চাঁদ উঠত। রিবিকা সেই চাঁদের কথা বলেছিল। এই চাঁদ ওই পাহাড় ছেড়ে কোথাও যাবে না। এইরকম মনে হত! আজ আকাশ এমন করে সেজেছে কেন। চাঁদ তার চারপাশে নীল কস্তুরী আভায় জড়িয়েছে এক গোল পুরু বৃত্ত। যেমন নীল তেমনি সাদা। কী দারুণ ছবি! সমস্ত রাতেই চাঁদ একটি তারকা সঙ্গে করে উদিত হয়। সেই তারকাকে চাঁদ ছাড়ে না। আজ অজস্র তারকা চাঁদের চারপাশে ঘিরে বসেছে। চাঁদ যেন কথা বলছে, তারকারা ঝুঁকে পড়ে শুনছে–এইসব তারকা কোথায় ছিল। এভাবে চাঁদের চারিদিকে জুটল কী করে! চাঁদ যেন সভা বসিয়েছে আকাশে।
০৯-১০. ফের সেই তাঁবুরই পৃথিবী
ফের সেই তাঁবুরই পৃথিবী। কনানে এসে তাঁবুরই তলে আশ্রয় পেয়েছিল। সৈনিক আর দেবদাসীরা। গৃহ পায়নি। সাদইদের ভাল লাগল, দেবদাসীর সঙ্গে অনেক সৈনিকের বিয়ে দিয়েছেন ইহুদ। তবে দেবদাসীর সংখ্যা বেশি ছিল না বলে অনেক সৈনিক অবিবাহিতই রয়েছে। সেই অবিবাহিতদের মধ্য থেকে কিছু সৈনিকের বিয়ে ইহুদ দিয়েছেন অনেক আগে আসা যাযাবর পরিবারে–যারা ইয়াহোর উপাসক। তবে সেইসব পূর্ববর্তী যাযাবর পরিবার যারা অত্যন্ত দরিদ্র এবং এখনও যারা তাঁবুরই তলে রয়েছে। তাছাড়া কিছু উট-উপাসক পরিবার ইহুদকে সম্মান করে–তারা সৈনিকদের পাণিগ্রহণে আগ্রহী–কিন্তু লোটার ঘটনা সত্ত্বেও সৈনিকদের ভিতর কেমন একধারা নাক-উঁচু ভাব ।
দেবদাসী, বিয়ের পরও কি দেবদাসী? নইলে অনেক সৈনিকের মধ্যেই কেন এক গোপন চোরা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে! তারা কনানী চাষীর মেয়ের সঙ্গে প্রেমে পড়তে চায়। দু’ একটি ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। প্রেম শুধু নয়, বিয়ে অবধি হয়েছে। তারা ভাগ্যবান। মেয়ের বাবা সেই জামাইকে গৃহ নির্মাণের জন্য এক টুকরো জমি দিয়েছে। খড়ের চাল আর মাটির দেওয়াল। তারপরই ঘটনা অন্যরকম হয়েছে। একটি বউ তাঁবুতে, অন্যটি, কম বয়েসী বউটি, রয়েছে কুটিরে। সৈনিকের হয়েছে দু’তরফ। ফলে দেবদাসীর এখন উপোসের কাল এসেছে। খেতে না পেয়ে শুকিয়ে থাকা। কেননা সৈনিক থাকে। কুটিরে–চাষবাসে ঢুকে গেছে। তাঁবু বাতাসে নিঃসঙ্গ ফটফট আওয়াজ করে চলে।
দেবদাসী থাকে একা। চাষীর ছেলেরা আসে। বিয়ে করতে নয়। ভোগ করতে। দু’এক কুনকে গম অথবা বাড়ি থেকে গোপনে নিয়ে আসা বউয়ের পুরনো কাপড়। দানধ্যান দেওয়া-থোয়ার এই হল বহর। এদিকে ঘরের বউটি ভারী মুখরা আর তিড়িঙ্গে–লাফিয়ে ছুটে এসে দেবদাসীর পরনের কাপড় ধরে টানলে—খোল্ মাগী কাপড়!
লজ্জায় তখন দেবদাসীর ধরিত্রী দ্বিধা হতে বাকি, মুখ লুকোবার মন্দির-কাণটি সে হারিয়েছে। কাপড় টানাটানির এই দৃশ্য দেখে সাদইদ স্তম্ভিত হয়ে যায়।
ইহুদের সামনে দেবদাসীর বিচার বসল। দেবদাসী বলল–লজ্জা ঢাকবার পরনের দু’প্রস্থ কাপড় দাদাবাবু দিয়েছিল! তারই খোঁটা এত! এই মারে তো সেই মারে! বলি কি এই সোনার অঙ্গে কুষ্ঠ হয় আমার। আমি পাপী! মহাত্মার সামনে বলছি, সামনে শীতে আমি আর বাঁচব না। জুম পাহাড় কী দোষ করেছিল শুনি–এখানে টেনে আনলে কেন? আমারও স্বামী ছিল, ঘর ছিল! তাঁবুর মিনসে কি মিনসে নাকি! কে দেয়, কে থোয়–দেখবার কে আছে! তাঁবুতে ফেলে রেখে চাষার ঘরে চলে গেল। আমি ধম্ম ধুয়ে খাব!