তারপর কী বলব ভাই, দুদিন যেতে না যেতেই আকাশ ফেড়ে ঢল নেমে গেল!
হেরা বলল–সবই শুনলাম। কিন্তু আমি নালা কেটে জল ধরে রাখার কথা বলছি। নিনিভের গ্রামগুলিতে এই প্রণালীর চাষাবাদ ছিল। জলকেও বাঁধা যায় মালী। পাথর ফেলে, তক্তা বসিয়ে বন্যা ঠেকানো যায়। এ তোমার ঢাকের কাঠির সঙ্গে হাতের লাঠির তজা নয়। সেটা শ্রম ঢালবার অন্য চেহারা। তা ওহে মালী, সেই কুমারী মেয়েটা তো বেঁচে আছে!
–আজ্ঞে আছে বইকি! যাবেন নাকি দেখতে! বাঁচার পর, মানে বলি তো হল না–সেই থেকে মেয়েটা বোবা হয়ে রয়েছে! দেখতে খুবই খাসা!
–আচ্ছা যাব! কোথায় থাকে!
–ওই আপনার উট-পাড়ায়!
–উট?
–আজ্ঞে!
ক্ষুব্ধ হেরা এই প্রথম কনানের মাটি খামচে তুলল হাতে। তৈরি করল একটি উটের মূর্তি। মরুভূমিতে পায়ে হেঁটে গিয়ে শুকিয়ে আনল। রঙ করল। সাদইদ ঘোড়া নিয়ে কোথায় চলে যায়, অনেক রাতে ফেরে না। উটের মূর্তি দেখে বলল–এটাও তো কাজ হেরা!
হেরা বলল–এটাই একমাত্র কাজ! এটা এক মূর্তিমান দেবতা। যে মেয়েটি বলি হয়ে যাচ্ছিল তার জন্য উপহার। আমি ভাস্কর নই। কারিগর। অজস্র মূর্তি দিয়ে এই দেশকে ভরে দেব সাদইদ। ইট কাঠ পাথর মাটি–সকল বস্তুকে দেবতা করে না তুললে মূর্তিহীন ঈশ্বর ডরাই না। ইহুদ কোথায় আছে–দেখে নাও, এরপর আত্মপ্রকাশ করে কিনা! আমার শিশুকে আমিই বহাল রাখব, সে নয়! সে কে?…
সাদইদ বলল–আমার এখন কিছু মিস্ত্রী, কারিগর আর শিক্ষিত নালা প্রস্তুতকারক চাষীর দরকার। আমি বিধ্বস্ত নগরী থেকে তাদের তুলে আনতে চাই। বাড়তি ফসল–উদ্বৃত্ত ফসল না হলে তোমায় কাজ দেওয়া যাবে না। আমার চাই প্রচুর খাদ্য। পরিধান। পশম। আতর। সুম। ফুল। প্রচুর প্রজাপতি।
–আমার এই উট–এই যথেষ্ট এখন।
মালী এসে হেরাকে নিয়ে গেল কুমারী মেয়েটির কাছে। হেরা তাকে উট উপহার দিয়ে সম্ভোগ করল। মেয়েটি বাধা দিল না। সম্ভোগ শেষ হলে মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে হেরা পাগলের মত ভাঙা ঘরটি ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে চলে এল পথে। মালী তাকে প্রচুর মদ খাইয়ে বলল–আপনি এবার কেঁদে হালকা হোন–আমরা জানি আপনার খুব কষ্ট ।
–কিছুই জানো না তুমি,আহাম্মক! আমাকে ঠকালে কেন? বলেই চড় মারতে গেল হেরা। পারল না। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। পড়ে রইল পথের উপর। মুখ ঘষড়াতে থাকল। বমি করল।
মালী বলল-শালা রসের নাগর। কুত্তা!
হেরা মদ খায়। মূর্তি তৈরি করে। দোকানপাটে সেই মূর্তি দিয়ে আসে। তার মন ভাল থাকে না। তার কষ্ট হয়, বুকের মধ্যে রয়েছে তার নিনিভে নগরী। তার পাগলামি কিন্তু সত্যিই ব্যর্থ হয় না। ইহুদ লক্ষ্য করেন, এইসব মূর্তি নিনিভের বাজারে পাওয়া যেত। দোকানপাটে সেই মূর্তি ছেয়ে গেছে। এই কারিগর কোথা থেকে এল! এ তো নাগরিক-বিদ্যার জিনিস!
লোক দিয়ে সাদইদকে ডেকে পাঠালেন ইহুদ–তোমার সঙ্গে কথা বলার তেমন কোন প্রবৃত্তি আমার নেই সাদইদ। তবু তোমায় ডেকে পাঠাতে হল!. বললেন ইহুদ।
সাদইদ বলল–আপনাকে আমি অনেকদিন ধরে খুঁজছি। আপনার সঙ্গে আমার বোঝাঁপড়ার শেষ হয়নি। আমি কাজের লোক। ধর্ম আপনার জিনিস! কিন্তু সেই ধর্ম যেন সত্য কথা বলে আমি চাইব! লোটাকে আপনি মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়েছেন একথা সত্য নয়। লোটা বাঁচেনি।
–তাহলে তুমিই তাকে হত্যা করেছ।
কথার শুরুতেই পা থেকে বক্ষস্থল অবধি এবং দাঁড়া বরাবর একটা হিম স্রোত বহে গেল সাদইদের। উচ্চাসনে বসে দিব্যতা-মুগ্ধ চোখে কথা বলছেন শান্ত তীব্রখরে ইহুদ। সাদইদ বুঝতে পারল মূর্তিহীন ঈশ্বর তুচ্ছ নয়। তথাপি খানিক ইতস্তত করে সাদইদ বলল-লোটা মারা গিয়েছে, হত্যা তাকে কেউ করেনি। হেরা দেখেছে!
–হেরা তো একজন পাপী মানুষ সাদইদ। মূর্তি বানায়। তা সে বানাক। কিন্তু নাগরিক পাপ যেন কুমারী মেয়েকে না দংশায়। নিভাকে আমি বলির হাত থেকে বাঁচিয়েছি–তাকে সে উটের মূর্তি উপহার দিয়ে বলাৎকার করেছে। বোবা মেয়েকে ধর্ষণ করার শাস্তি কী হতে পারে বিধান দাও হিতেনের পোলা। কী হে ভিত্তি! নিভাকে ডেকে আনো! আমি সমস্ত আঙুল কর্তন করব না। খালি ডান হাতের বুড়া আঙুলটা কেটে দেব। নদীতে বাঁধ বাধলেই হয় না সাদইদ। বাঁধ বাঁধো চরিত্রে! অবশ্য তোমার আর আমার সত্যের ধারণা আলাদা। কিন্তু তোমার ধারণা অনুযায়ী হেরার মৃত্যুই অনিবার্য ছিল।
–এতবড় শাস্তি ওকে দেবেন না মহাত্মা ইহুদ!
–কেন দেব না?
সাদইদ কোন উত্তর দিতে পারল না। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। শিশু কোলে করে দাঁড়িয়ে ছিল রিবিকা,ইহুদের আসনের আড়ালে। লোটার মৃত্যুর কথা সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার জানতে ইচ্ছে করছিল কোথায় কীভাবে লোটা মরেছে। তার চোখের সামনে বারবার লাফিয়ে উঠতে থাকল। দিগন্তাভিসারী এক কৃষ্ণ অষ। তার গলায় আজ আর কোন কান্না এল না। সে অপেক্ষা করেছে দিগন্তের দিকে চেয়ে। কেঁদেছে। কিন্তু কান্না এক সময় নিজেই থেমে গেছে।
আজ মাথা নিচু করে থাকা সাদইদকে দেখে তার অন্তর কেমন মুচড়ে উঠল। একজন সামান্য চাষীর পোশাক পরা এই কি সারগন! মহা অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ইহুদ সহসা কঠোর স্বরে বললেন–ঠিক আছে। দুটি শর্ত তোমায় পালন করতে হবে। প্রথমত হেরা আর মূর্তি বানাবে না। দ্বিতীয়ত নিভাকে সে বিবাহ করবে। যাও! ওহে কে আছে ওকে ওর শিশুকে দিয়ে দাও!