ভোরের দৃশ্য আলাদা। বুড়ি ছুটে এল সাত সকালে। এসেই সে যেমন করে লোটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিত, ঠিক তেমনই ভালবাসায় সাদইদের গায়ে হাত বুলিয়ে চলল। সে যেন যুদ্ধের রক্ত মুছিয়ে দিচ্ছে। লোকে সবাই ভিড় করে এল। বুড়ির আহ্লাদ ধরে না। যুদ্ধের দ্বাত্মক রুদ্রতার আড়ালে বোবা এই বুড়ি পড়ে ছিল! এককোণে। যুদ্ধ তাকে কী করে যেন ধর্তব্যই ভাবেনি। অথচ সে ছিল। এই বউটি তার ছেলের বউ। তাদের সে ফিরে পেয়েছে। কিন্তু তার থাকাটাই বিস্ময়কর!
হেরা বলল–তুমি বুড়িকে মিথ্যে কথা বললে কেন?
–বুড়ি শুনতে পায় না হেরা! ওর কাছে লোটার মৃত্যু নেই! আর এরকম একজন মানুষকে সবাই বিশ্বাস করে। ও না থাকলে জীবনটা শুরু করাই যেত না।
এইভাবে গ্রামে ঠাঁই পেল ওরা। কিন্তু শিশুর সন্ধান তারা পেল না। হেরা একদিন নির্জন দুপুরে ফুঁপিয়ে উঠল নদীর মৃদু কলোলিত স্রোতের দিকে চেয়ে। তার বুকের ভিতর রয়েছে অবলুপ্ত বিধ্বস্ত নগরীর স্মৃতি। সে প্রসিদ্ধ স্থপতি। কিন্তু আজ তার কোন কাজ নেই। গ্রামের কুঁড়েঘরে তাকে থাকতে হয়। অত্যন্ত নিম্নমানের পরিবেশ। স্যাঁতসেতে ঘর। কখনও বৃষ্টিতে মাটি ফুলে ওঠে জোঁকের মত। মরুভূমির তপ্ত হাওয়ায় সেই গৃহ হাহাকার করে কখনও বা। নদীর বন্যায় সেই কুটির তলিয়ে যায়। এখানকার চাষবাস অত্যন্ত পুরনো ধরনের। বীজ ছিটিয়ে তার উপর দিয়ে ছাগল ভেড়ার পাল দৌড় করানোর বুদ্ধিও জানে না–যাতে করে পশুর পায়ের দাপানিতে বীজ পুঁতে গিয়ে তোফা উদ্ভিদ দিতে পারে। কিছুই জানে না। এত খাদ্যাভাব এখানে। আকাশে মুখ তুলে হাহাকার করা আর রাতদিন ঢোল বাজিয়ে বালদেবের মন্দির মাত করা এদের কাজ। চারিদিক থেকে নানান জনপ্রবাহ এসে মিশেছে–কাউকে এরা খেদায় না। নানান দেশে পৌঁছনোর রাজপথগুলি এই দেশের বুকের উপর দিয়ে চলে গেছে। রথ, অশ্ববাহী সেনা, পদাতিক ছুটাছুটি করেছে এই পথে। চাষী তা চেয়ে চেয়ে দেখেছে।
চোখের সামনে সৈন্যরা ঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার খেলা খেলে চলে গেছে–চাষী মুখ বুজে থেকেছে। মিশরের দূতরা এসে লোভ দেখাতোযুদ্ধে চলো, প্রচুর উপহার দেব–মাতব্বর যদি হ্যাঁ করে মাথা নেড়ে দেয়,রাজা করে দেব। চাষী প্রলোভনে ভোলেনি। যুদ্ধ করা নয়, যুদ্ধ দেখা এদের রোমাঞ্চ। যুদ্ধ থামলে এরা বীরের গল্প ফাঁদে–আরে ভাই অমুক সারগনের কথা বোলো না–এমনি হাঁকলে ওই দেওদার তলায় দাঁড়িয়ে যে, লেডুর গর্ভবতী বউটা ছেলে বিইয়ে বসলে! লাও লেঠা!
বলেই বিবরণকতা মাড়ির দাঁত বার করে এমনি নিঃশব্দে হাসলে যে, সেই হাসিটা গাঁময় ছড়িয়ে গেল, যারা দেখেছে তারাও তো আকুল, হেসে অস্থির, যারা মাড়ির বর্ণনা শুনল তারাও নিরাকুল হাসিতে আকাট হয়ে রইল। তারপর দলে দলে শুঁটকি মাছের চাট দিয়ে আঙুর তাল খেজুরের চোলাই মেরে তামাম রাত দেবী ইস্তারের ভাসান শুনল। দেবী কী করে পাতালে যেতে যেতে ক্রমশ নগ্ন হয়ে যাচ্ছে, বস্ত্রহরণের সেই দৃশ্যে মেতে গেল গ্রাম। তখন নদীর জল ফেপে উঠে মরাই তলিয়ে মাটির গোলার তলা ফাঁক করে ডিহি ছুঁয়ে এসে ভাসান শ্রোতাদের পাছার কাপড় ভিজিয়ে দিলে। সবাই তখন চমকে লাফিয়ে উঠে বলল–ওরে বাপ। হায় দেবী–এ যে বান বটে গো!
এরা নদীতে বাঁধ দিতেও জানে না। নালা কেটে জলাশয় তৈরি জানে না। বান হলে পূজা দেয়। বজ্ৰ গজালে পূজা দেয়। মাটি শুকালে জিভ ফুড়ে একটা লগির সঙ্গে শেকল বেঁধে ঝোলে। বলে, লে মাতৃকা রক্ত খা! এ হল এদের দুর্ভিক্ষের শুখা মাটির মাদল বাজানো উৎসব। এই উৎসবে হঠাৎ জড়ো হওয়া কোন বহিরাগতকে দেখলেই হোতা ব্যক্তিটি শুধায়–মশাইয়ের যুদ্ধ জানা আছে নাকি! ভাড়াটে, না আসল! বহিরাগত মিটকি মিটকি হাসছে দেখে বললে–আচ্ছা নিবে নগরে একটা পাঁচিল ছিল শুনেছি। দেখতে কেমন ছিল মশাই! শুনেছি প্রস্থে আপনার কত গুণিতক কত হাত যেন পুরু। তা বেশ! শুনি সেই পাঁচিল নাকি ধ্বসে গেল তিনতলা সাঁজোয়ার ধাক্কায় । মিথ্যা বলব না। দু’ একখানা দেখেছি! এই রাস্তা ধরে গেছে…তিনতলা–সব চোলাই আর দেবদাসী ভর্তি হয়ে চলে গেল! দেখবেন, ঈষৎ রঙ লাগলে বলবেন, কথায় রঙ দেওয়া ঠিক নয়।
–না না। বলুন। বেশ বলছেন আপনি। পাঁচালী শুনেছি তো, তাও এত ভাল লাগে না।
উৎসাহিত দ্রাক্ষাবাগিচার মালী বলল–একথা শুনে ইহুদ বললেন, মেয়েলোক বাড়লে, দেবদাসী বাড়লে, বেশ্যা বাড়লে জানবে–এটা যুদ্ধের লক্ষণ! দ্যাখো আর নাই দ্যাখো, এটা যুদ্ধ। পুরুষ কমে যাচ্ছে, এটা যুদ্ধ! একথা মহাত্মার কাছে কোথায় শুনলাম শুনবেন! গত মাসে ওলাওঠা দেবীর থানে। না ভাই ঈষৎ ভুল হল। শুনলাম ভোমরাতলীর হাজারী থানে। ও গাঁয়ে কুমারী বলি হচ্ছে সেদিন। মহাত্মা এসে ঢাকের কাঠি হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন কুমারী মেরে বৃষ্টি নামে না–ইয়াহোকে ডাকো! তা আমরা ইয়াহোকে ডাকি না এমন নয়। ডাকি। অবসর পেলে ডাকি! বাপঠাকুদ্দা কুমারী বলি দিয়েছে, চারটা দশটা বিয়ে করেছে–আমরাও করছি। পূজা করলে কি আর ইয়াহোকে ডাকা যায় না। খুব যায়। ধম্ম ঠাকুর জানে, এই দিগরে দশটা কুমারী বলি হলে হুড়মুড়িয়ে আকাশে মেঘ জমে যাবে। ফলে সবাই মহাত্মাকে মারতে তেড়ে গেল! ইহুদ আকাশে লাঠি উচিয়ে বললেন, আমি নোটাকে মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধার করেছি। আমি পারি! মেঘ জমবে। ওই দ্যাখ পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। আকাশের তলায় রুদ্র জিহ্বা নীল রঙ চাটছে। মেঘ জমবে। ইয়াহোকে ডাকো।