সমস্ত ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে পড়ছিল রিবিকার। আক্কাদ সেদিন তিনটি ভেড়ার লোম কেটে তূপীকৃত করেছিল, এবং রিবিকাকে পেয়ে লোমসুদ্ধ তিনটি ভেড়াই দিয়ে দিয়েছিল কনানীয় দরিদ্র পরিবারটিকে।
লোমছাড়ানো হতকরুণ একটি মেষ যেমন, রিবিকা নিজেও তাই–ভাগ্যের কথা মনে হলে, বারবার তার তিনটি ভেড়ার ছবি মনে পড়ে। আক্কাদ তাকে যত সস্তায় কিনেছিল তত কম দামে বেচেনি, চড়া দাম নিয়েছিল মিশরীয় এক বণিকের কাছে। আসলে আক্কাদ তাকে চড়া দরে বেচে দেবার জন্যই যে। কিনেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু কেনার সময় দেবী ইস্তারের নামে, কৃষিদেবতা। বালদেবের নামে দিব্যি গেলেছিল, সে রিবিকাকে কন্যার মত দেখবে এবং বেচে দেবে না। বলেছিল-উটের গা ছুঁয়ে কসম খাই মা!
মিশরীয় সেই বণিক পুরনো নগরী আমারনার লোক ছিল। লোকটি সূর্যদেবতা আটনের জন্য রচিত সূর্যস্তোত্র আওড়াত। এর নাম ছিল নমরু। মিশরের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু সম্প্রদায়ের লোক। সংখ্যালঘু আক্কাদ করত উটের পূজা। নমরু করত সূর্যস্তব। ভাবতে অবাক লাগে, এরা দুজনই এমন ধর্ম পালন করত, যার কোন মিলই নেই। সেদিক দিয়ে দেখলে আক্কাদ ছিল বিদ্রোহী আর কোণঠাসা, একটেরে লোক। ইহুদের আবার এই দুই ধর্মসম্প্রদায়ের উপর সহানুভূতি লক্ষ্য করা গেছে। রিবিকা যখন যেখানে থেকেছে সেই ধর্মই পালন করেছে। তবে দেবী ইস্তারের মত এত স্পষ্ট কেউই নয়, অন্তত রিবিকার তাই মনে হয়েছে। এই দেবী যেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা (সেকালে সেখানে অন্ন বলতে যব গম ইত্যাদি বোঝাত), কোমল, ভীরু আর নগ্ন। নবান্নের দেবী। অন্নপূর্ণাই বল আর লক্ষ্মীই বল, এত অসহায় কেউ নয়, এত পূর্ণশ্রীও কেউ না।
টুকরো টুকরো ভাবে কত ছবিই না মনে পড়ে! পূর্বদেশের নবান্নের রাত, যে-রাতে আক্কাদ তাকে প্রথম সম্ভোগ করেছিল উটের পিঠে শুইয়ে । কন্যা হয়েছিল উপপত্নী। তখন রিবিকার বুকে কেবলই কুঁড়ি ফুটেছে। স্তনবৃন্তে মর্দন করা লোকটার মেটে সাপের মত আঙুল সিরসির করছিল; ঘৃণায় আর ভয় মেশানো কামার্ধ দেহে রিবিকা কেঁদেছিল–তার যোনি-প্রদেশ রক্তাক্ত করেছিল গর্দভ-লিঙ্গ পশুটা। সে বারংবার রিবিকাকে বুঝিয়েছিল, উটের পিটে যৌন আস্বাদন করলে পুণ্য হয়, এ জিনিস সুন্নৎ। নবী সালেহ তাতে খুশী হন।
উটের কুঁজটা নবী সালেহর কবর। এখানে তিনি শুয়ে আছেন। এই অনুমান পূর্বদেশগুলির সকলেই বিশ্বাস করত। কেন করবে না? সালেহ ছিলেন মরু আরাবার আমোরাইট বা আমেলেক জাতির লোক, আব্রাহামের বংশের মানু নোহের পুত্র সামেরের গোত্রভুক্ত, তথাপি উট-উপাসক। নিশ্চয়ই বারো গোষ্ঠীর এক গোষ্ঠী এরা। নবান্নের রাতে আক্কাদের লোকজন উটকে মাল্যে পুষ্পে সুর্মা তিলকে সাজাত, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে দিত। এই রাতে তারাও দেবী ইস্তারের সামনে যৌনাচার করত। এই রাতে সমূহ গ্রাম নগরী সেজে উঠত। গ্রামে এবং নগরে সর্বত্র উৎসব চলত। চাষী জীবনে উটের প্রভাব তেমন ছিল না, কিন্তু যৌনাচারের রাতে কোন কোন চাষীপুত্র উটকে ব্যবহার করত তার আন্দোলিত পৃষ্ঠভূমিতে যৌনবিহারের জন্য।
দুটি ধর্ম–নির্দিষ্ট এই রাত্রিতে মিলিত হত। নবান্নের রাতেই আক্কাদ রিবিকাকে উটের পিঠে জোর করে তুলে নিয়েছিল। সেই সময় আক্কাদের চোখদুটি দপ দপ করে জ্বলছিল। আক্কাদের চোখে হীরা পর্বতের নীল সুমা। মোসি যে পর্বতে ঈশ্বর যবহের প্রত্যাদেশ পেয়েছিলেন, সীনয় উপদ্বীপের হীরা পর্বতটি, অতএব সীনয় পর্বতেরই সংলগ্ন অথবা সীনয়েরই অন্য নাম হেরোর বা হীরা। অথবা হীরা কোন গুহা মাত্র। যাইহোক, হীরার পবিত্র সুর্মা চাষীদের চোখেও সেই রাতে জ্বল জ্বল করছিল পশুচর্বির মশালের আলোয়। আলোর ফোয়ারা উঠছিল আকাশের দিকে। মিলনের এমন রাত পৃথিবীতে কমই আসে।
নবান্ন আর দোলের রাত একই রাত। আকাশে পূর্ণিমা। উদ্ভাসিত আলোয় প্লাবন বইছে চরাচরে। দেবী ইস্তার অলংকৃতা। ঢোল বাজছে বাতাসে। উট সুসজ্জিত। সবার পরনে বেগুনি রঙের পোশাক। মরুসরষের পাঁপড়ি আর বোঁটায় রাঙানো–বোঁটা বেগুনি, পাপড়ি হলুদ। রঙে ছোপানো হয় সেদ্ধ করার পর। রিবিকার গায়ে কাঁচুলি–দুই-তিনটি স্তরে পাতলা কাপড়ে ঢাকা বক্ষবন্ধনী)–আর কোন পোশাক নেই। মধ্যরাত্রিতে গায়ে সামান্য সুতো রাখাও নিষেধ। ধর্মের নিষেধ। দেবী ইস্তার ক্ষুণ্ণ হবেন। আক্কাদীয়রাও সেকথা বিশ্বাস করে। কাঁচুলি পরা বিদেশী নাগরিক প্রভাব । চাষীরা অনেকে কাঁচুলি পরলে ঠাট্টা এবং ঈষৎ কটুক্তি করত।
আক্কাদের মা তাড়া দিচ্ছিল–যাও বাছা! আক্কাদ উটের পিঠে অপেক্ষা করছে। বুকে ওইরকম লাগাম পরেছ, লজ্জা হয় না? এত শউরেপনা ভাল না!
কথাটার ইঙ্গিত বালিকা রিবিকা বুঝতে পারছিল না। ঢেলে সেই কখন কাঠি পড়ে গিয়েছে। দেবী ইস্তার শেষ রাতে পাতালে নামবেন। যমালয়ে প্রবেশ করবেন তিনি। যমের বাড়ি পাতালে,এই হল লোকবিশ্বাস। মাটি ও বৃষ্টির দেবতা তামুজদেব মাঠ থেকে হলুদ শস্য কেটে নেবার পর পাতালে চলে যান। যমালয়ে যাত্রা করেন। মাঠ শূন্য। একটি দানাও সেখানে পড়ে নেই। আকাশ মেঘহীন। মরুভূমির শীত সামান্য হালকা হয়েছে। দোল রাত্রি এসেছে। নবান্ন হয়েছে প্রথমে একবার। যখন ফসল উঠেছিল। এবার হচ্ছে দ্বিতীয়বার। এটাই বড় উৎসব। এই উৎসবটি হয় বীজ গমের পায়েস দিয়ে, দেবীকে খাইয়ে, তেভাগ দিয়ে, পাঠানো হয় তামুজদেবকে উদ্ধার করতে। তামুজদেব পাতাল থেকে ফিরে না এলে আকাশে মেঘ জমবে না। আঁর প্রিয়তমা দেবী ইস্তার ছাড়া তাঁকে বাঁচিয়ে তুলে যমালয় থেকে ফিরিয়ে আনার কেউ নেই। দেবীকে সাত সাতটি তোরণ অতিক্রম করে যমালয়ে পাতালে শেষ স্তরে পৌঁছতে হবে।