–তবু রূপ যে খুব গুরুতর বিষয় হেরা! তা যে একটা প্রজাপতি!
–তোমার কথা আর বোঝা গেল না।
–আমিও ঠিক বুঝি না, বালিতে মূর্তি হয় না কেবল এটুকু তোমায় বলতে পারি। দ্যাখো, রূপ, আকৃতি, জ্যামিতি, একটা ছায়া–এসব আমার চাই। পরমায়ু যখন ফুরায় তখন একটা পিরামিড খাড়া হয়। পাহাড়ের গুহায় আঁক শিকার শিকারী–এ তো ছায়া। নিনিভের গায়ে আঁকা রাজা চলেছে মৃগয়ায়–রাজা থাকল কি গেল সেটা কথা নয়। ছায়াটাই আসল। রূপ তাছাড় কী? তুমি কেন আমার সঙ্গে এসেছ! নিনিভে নেই। কিন্তু তোমার হৃদয়ের ভিতর সেটা দেখতে পাও! পাও না?
–পাই।
–তবে? বল, এমন কেন হয়! আমি কেন দুটি প্রজাপতি আর লোটার করুণ মুখখানা ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনে। লোটা হিতেনকে বশবিদ্ধ করে মারে। এইজন্যই মারে যে,রাজা হিতেন তাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে বধ করতে চেষ্টা করে। সেই সময় আকাশ ছেয়ে যায় ঈগল পাখিতে-পাখিরা মড়ব সংকেতকারী লাল ইঁদুর নখে ধরে উড়ে আসে, কারণ ইঁদুর তাদের খাদ্য। ভয়ে রাজা তার দলবল নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে–ছুটে চলেছে–এমন সময় লোট বশ ছোঁড়ে। এটা একটা অভিজ্ঞতা। তারপর লোটা পশুদল নিয়ে বালি ছেড়ে মাটির দিকে যাচ্ছিল। সে একটা ছবি হতে চাইছিল। আকাশে একটি যুদ্ধ চলছিল ঈগলে আর ইঁদুরে। নিচে ঘটছিল হিতেন আর লোটার যুদ্ধ। তাহলে বল, এখানে ইয়াহোর ইশারা কোথায় ছিল!
হেরা অনেকক্ষণ মুখ বুজে থেকে বলল–তোমার অভিজ্ঞতা স্বাভাবিক কিন্তু কারো কাছে সেটা স্বাভাবিক না-ও হতে পারে। ক্রমাগত যুদ্ধ সমস্ত রূপ আকৃতি, ছবি, জ্যামিতি, তাঁবু, গৃহ সব–সমস্ত ভেঙে দেয়। তামাম কিছু অদৃশ করে দেয়। তাহলে অদৃশ্য একটা জগৎ আছে কোথাও। ইহুদ মনে করেন ইয়াহো সেই জগতে থাকেন। তোমাকেও ভেবে দেখতে হবে এসব কথা লোটা ছিল, লোটা নেই।
সাদইদ হেসে ফেলে বলল–এভাবে আমায় বোঝাতে পারবে না হেরা! য কিছু অদৃশ্য হয় তা মানুষ আবার ফিরিয়ে আনতে পারে। সব ছবি । এবং তা আরো সুন্দর করে আনতে পারে। সব রূপ। সমস্ত।
–হ্যাঁ পারে! পারে বইকি!
বলতে বলতে দূরে কুটিরের আলোর দিকে চাইল হেরা। একটি বউ ছোট মশাল ধরিয়ে আলোর শিখার দিকে উপরে চোখ তুলে চেয়ে আছে। অন্যমনস্ক সুরে হেরা অতঃপর বলল–কিন্তু লোটা আর ফিরবে না!
–সে তো ইয়াহোর ইচ্ছে! সেই ইচ্ছেয় আমার আগ্রহ নেই। কারণ লোটাকে ফেরানোর ক্ষমতা আকাশের খোদারও নেই। রেগে যেও না স্থপতি! যা তিনি ফিরিয়ে দেন না নিয়ে ব্যাখ্যা চলতে পারে কিন্তু সেই ব্যাখ্যায় অদৃশ্য জগৎটা অদৃশ্যই থেকে যায়–আলো পড়ে না সেখানে। সেই অন্ধকার আমি চাই না।
–রেগে তো তুমিই গেছ সাদইদ! তর্ক তুমিই করছ!
–তর্ক তো এক মুখে হয় না। যা আমি সবচেয়ে ঘৃণা করি, সেই অদৃশ্য জগতের কথা তুললে! বরং একটি বীজ থেকে একটি গাছ কীভাবে উঠে আসছে, সেই পর্যবেক্ষণ অনেক সুন্দর। তোমার শিশুকে যেদিন নলখাগড়ার কাগজে তৈরি নৌকা, উপহার দিলাম–সেদিন সে হেসে উঠেছিল। আজও সেই হাসি দেখতে পাই। এর চেয়ে সুন্দর আর কী আছে! এই নৌকা আমার পিতা নোহ বানিয়েছিলেন। জীব এবং বীজের সুরক্ষার জন্য। আমি কাগজের নৌকা বানাতে বানাতে ভেবেছি আসল নৌকা জ্যামিতি মাত্র কাঠের বাহু ছোটবড় করে গাঁথা–এই বুদ্ধি নোহের ছিল।
হেরা বলল–কিন্তু এখন আমার সমস্ত বুদ্ধি লোপ পেয়েছে সাদ। ভয়ংকর রাত। কড়িয়ে শীত পড়বে! বাঁচব তো? দাঁড়াবার মত মাটিও যে পাইনি!
একটু ভেবে হঠাৎ সাদইদ বলে উঠল–একটা উপায় হতে পারে হেরা! চলো ওই বউটার কাছে গিয়ে প্রার্থনা করি! যুদ্ধ নারীকে সবচেয়ে বেশি ক্ষয় করে–কিন্তু চাষীর ঘর–দয়ামায়া থাকতে পারে! একখানা কাঁথা যদি দেয়, রাতটা তাহলে কোনরকমে কাটিয়ে দিতে পারব!
কাঁথা চাইতে গিয়ে আশ্চর্য ঘটনা হয়! বউটি ওদের দেখে স্তম্ভিত হয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ফিক করে হেসে ফেলে মেঝেয় পড়ে থাকা কাঁথা জড়ানো এক বুড়িকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে জাগিয়ে তোলে। বৃদ্ধা ঘুম জড়ানো চোখে সাদইদকে দেখে ভয়ানক আশ্চর্য হয়। এ যে সাদইদ! সারগন!
বোবা বুড়ি অদ্ভুত অব্যক্ত আহ্লাদে চাপা স্বর তোলে মুখে। বউ বুঝতে পারে লোক দুটি খারাপ নয়। বুড়ির চেনাজানা ঠাহর হচ্ছে। বুড়ি তার আঁচল খুলে কুমীরের প্রতীকগুলি দেখিয়ে অভিমানের সুরে জিভ ঠেলে ঠেলে একটা শব্দই কেবল বার করতে পারে বহু কষ্টে–লোটা! লোটা!
শিউরে ওঠে সাদইদ।
–তুমি চেন? প্রশ্ন করে হেরা!
অশ্রুরুদ্ধ স্বর চেপে বুড়ির মুখের কাছে মুখ নামিয়ে সাদইদ বলল–লোটা আসবে বুড়ি-মা! একদিন লোটা কি আসবে না! দ্যাখো, কেঁদো না!
কুমীর বুড়ি এ সংসারে কী করে এল? কপাল চাপড়াচ্ছে বোবা ভাষায় করাঘাত করতে করতে! মশালের আলো কাঁপছে! নদী থেকে বাতাস বহে আসছে! বাতাসে আঁশের গন্ধ! বোধহয় কোথাও মাছের জালও অন্ধকার উঠোনে টাঙানো আছে। নইলে গন্ধ এত স্পষ্ট হবে কেন! এ তবে চাষী পুরোপুরি নয়, জেলেও বটে। কুমীর সেই নদী অববাহিকার ত্রাস। দেবতা মাত্র।
কাঁথা ওরা পেল। ভাঙাকুটিরে ফিরে এল। সমস্ত রাত দাঁত কাঁপানো শীত। কাঁথা গায়ে দেওয়া দুটি সুন্দর বলিষ্ঠ গাভী সারারাত শীতে নাদলো আর প্রস্রাব করল ছড়ছড় শব্দে। একই ভাঙা কুটিরে বাঁধা থাকল দুজন মানুষ আর দুটি গরু।