–অ। ঠিক আছে!
দণ্ডভর দম বন্ধ রেখে সাদইদ দিগন্তের আবছা গ্রামগুলির দিকে চাইল। চেয়েই থাকল। তার চোখ অপ্রতিরোধ্য অশুতে ছলছল করে উঠল। শান্ত গলায় সে বলল ঠিক আছে। এখান থেকেই যখন শুরু করতে চাই! নাও, তুমি সাদাটায় গিয়ে উঠে পড়। আমি লোটার ঘোড়ায় চড়ছি। আমাকে মৃত্যু স্পর্শ করবে না। যদি তাই হত, তাহলে তোমাকে সঙ্গে নিলাম কেন? মড়ক আমাকে ধরবে না স্থপতি!
শেষের বাক্য দুটি সাদইদের গলার খাদে বুজে গেল। ততক্ষণে শ্বেত অশ্বের পানে এগিয়ে গিয়েছে, হেরা শুনতে পেল না।
সাদইদ কালো অষের পিঠে চড়ে হু হু করে কেঁদে ফেলল নিঃশব্দে। তারপর সে তার অনভ্যস্ত গলায় যাযাবরী স্বর নকল করে চিৎকার করে উঠল–হরররররহু! হরররররহ্! হাহা! হিররররর হে! হিরররর ইহ! হো হো! উররররহ্! হট হট হাঃ! হা হা হ্!
কালো অশ্ব পশুদলকে খেদিয়ে নিয়ে চলল। পড়ে রইল লোটার নিষ্প্রাণ দেহ। বৃক্ষের ডালগুলি মরুশকুনের ভিড়ে থিক থিক করছে। চোখগুলি হলুদ রেখার বৃত্তে তালশাঁসের ভিতরের জলের মত টলটলিয়ে উঠছে।
গ্রাম ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল। সবুজ গাছপালার নিবিড় ছবি। এই তার জন্মভূমি। সেই জন্ম যেন কিংবদন্তীর মত । পিতা নোহ কখনও এখানে ছিলেন নশ্চয়। মিশরেও ছিলেন তিনি। তিনি রয়েছেন রক্তে আর নিঃশ্বাসে।
সাদইদ মনে মনে বলল–এই জীবগুলি সবই লোটার দান পিতা। এদের তুমি রক্ষা কর। হেরার পুত্র যেন বেঁচে থাকে।
.
০৮.
দ্বিতীয় পর্ব
তারপর বেশ কিছু বছর কেটে গেছে মধুদুগ্ধের দেশে। রিবিকার সঙ্গে সাদইদের দেখা হয়নি। সাদইদ তার জীবন শুরু করেছিল একটি বৃক্ষের মত। একটি ছোট গ্রামে নদীর তীরে ছোট কুটির বেঁধেছিল। চাষীর চোখে ছিল তার প্রতি ঘৃণা আর করুণা। পশুদল নিয়ে সে প্রবেশ করেছে, যাযাবর যেমন প্রবেশ করে। রাত্রির অন্ধকারে হানা দিয়েছিল যেন সে। চাষীরা তার পশুগুলি কেড়ে নিয়ে বলেছিল–যা ভাগ! এ লোক যুদ্ধ বাধাবার জন্য এসেছে নিশ্চয়। শোন ভাই, এখানে ওসব চলবে না।
মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর চাষীদের সাদইদ বলল–পশুগুলি আমি তোমাদের জন্যই কষ্ট করে এনেছি। আমি যুদ্ধ-ফেরত একজন সাধারণ সৈনিক। চাষবাস জানিনে। এই সব গরু আমার কোনই কাজে লাগবে না। তোমরাই রাখো। তবে আমায় তাড়িয়ে দিও না। এ আমার বন্ধু হেরা। নিনিভের লোক। ওর বউ মড়কে মরেছে। শিশুপুত্র হারিয়ে গিয়েছে। বাচ্চাটিকে আমরা খুঁজছি। আমাদের আশ্রয় দাও। মহাত্মা ইহুদের কাছে আমাদের ছেলেটি রয়েছে, ওঁর এক মেয়ের কোলে আমরা তাকে দিয়েছি।
–কোন্ মেয়ে সেকথা বলবে তো! তাঁর কি মেয়ের শেষ আছে? অবিবাহিত ইহুদের চোখে মেয়ে মাত্রই হয় মা, নয় মেয়ে। অতএব সঠিক করে বলতে হবে কার বউ, কার কী, কোথায় থাকে–গ্রামের নাম–সবকিছু বলতে হবে! ইহুদ থাকেন পাহাড়ে–কোন্ পাহাড়ে তাও আমরা দেখিনি। কত শিশুই যে তাঁর দয়ায় বেঁচেছে! তিনি তো মহাপুরুষ! হলফ করে বলতে পারি ওই ছেলে নষ্ট হয়নি। মহাত্মা বহাল রাখেন, নষ্ট করেন না!
একজন মধ্যবয়স্ক চাষী গড়গড় করে বলে যেতে লাগল। একজন বৃদ্ধ তাকে সমর্থন করে বলল–হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক! মড়কের মুখ থেকে তিনি রক্ষা করেন, যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচান। রাজা হিতেনের অতবড় সৈন্যদল তাঁর লাঠির ইশারায় মাটিতে শুয়ে গিয়েছিল, আর ওঠেনি! রাজা মুখে রক্ত তুলে পথের ওপর পড়ে গেল। সেই যে পড়ল, আজও পড়ল, কালও পড়ল। বলি কি, ছেলে নিশ্চয় আছে, নষ্ট হয়নি।
মহীপাল নামে একজন সম্পন্ন কৃষকের গোয়ালে গরুগুলিকে লোকেরা বেঁধে দিল–ভেড়াগুলিকে খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দিল। তারপর বলল–যাও, ঢুঁড়ে দ্যাখো!
এইভাবে মধুদুগ্ধের দেশ সাদইদ আর হেরাকে অভ্যর্থনা জানায়। হেরা ধৈর্য, রিয়ে বলে ওঠে–শিশুকে আমি আর পাব না সাদ!
–পাবে। নিশ্চয় পাবে। অতবড় একটা নগরের স্থপতি তুমি। একদিনে সই নগরী গড়ে ওঠেনি। তুমি কত ধৈর্যে সেই রূপ তোয়ের করেছ। আগে কিটু ঠাঁই দরকার। তারপর শিশুকে খুঁজব আমরা।
–ঠাঁই তুমি কোথাও পাবে না! তখন সেদিন রাগ করেছিলে, এখন দেখলে তা যাযাবর ভাড়াটে সৈনিকের কোথাও জায়গা নেই। মড়কের নগরী থেকে সেছি বলে এই একটা ভাঙা কুঁড়ের কাছে ফেলে রেখে ওরা দিব্যি চলে গেল! লো ফিরে যাই।
–কোথায় যাব! জীবনভর এই একটা দেশের স্বপ্ন দেখেছি হেরা! সন্যদের বলতাম যদি কখনও একটা গ্রামের অধিকার পাই… থাক সে কথা। এলাম তো যাযাবরের মত। অথচ এ আমার নিজের জন্মস্থান। কেউ আমায় চনে না। আবার আমি মরুভূমিতে ফিরে যাবো! সেই তাঁবুর জীবন, সেই উটের গাম ধরে পথ চলা।
–তাহলে ইহুদের শরণাপন্ন হও। তার ধর্ম গ্রহণ করো।
–অসম্ভব!
–কেন?
–ইহুদের ধর্ম মরুভূমির ধর্ম! মাটি ছাড়া মূর্তি হয় না। ভেবে দ্যাখো!
–হ্যাঁ! সেকথা ঠিক।
–বালি মুঠো করলে মূর্তি তো হবে না!
–না।
–মরুভূমি একঘেয়ে। ধূসর। যতদূর চাও কোন ছবি নেই।
–নেই বটে।
–ইহুদের ধর্মের ঈশ্বর পাহাড়ে থাকেন। তাঁর কোন রূপ নেই। আছে কবল আগুন-ঝরা দুটি চোখ। চোখ দু’টিও দেখা যায় না। কল্পনা করা যায় ত্র। রূপ মানে তো মাটি। মানে গ্রাম + ছবি। ঠিক তোমায় বোঝাতে রছিনে।
–বুঝতে কিছুটা পারা যে না যায়, তা নয়। তবে সেই ইহুদই জিতে গছেন। মূর্তিহীন ঈশ্বরই সব দখল করেছেন–এখন তুমি কী করবে!