কিন্তু তাই বলে লোটা এভাবে থেমে পড়বে। ও হয়ত মৃত্যুর একদণ্ড আগেও ভেবেছে, রিবিকার কাছে পৌঁছতে পারবে। ওর বিয়ে হয়েছে মাত্র কিছুদিন। আগে। ও রিবিকার জন্য ধর্ম অবধি ত্যাগ করেছিল। এই পশুগুলি সে প্রচণ্ড মেহনত করে জোগাড় করেছে। মৃত্যুর গহ্বর থেকে টেনে এনেছে।
এইসব ভাবতে ভাবতে সাদইদের বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠল। হেরা বোঝে কিনা জানা নেই, যে মানুষ মড়কের ভিতর থেকে পশুদের জোগাড় করে আনে, রাজা হিতেনকে বর্শায় গেঁথে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে ঘোড়া ছোটায় নিনিভের দিকে, তার থেমে পড়া উচিত নয়। এই মুহূর্তে তার জেগে উ পণ্ডদল তাড়িয়ে নিয়ে দিগন্ত পার হয়ে গ্রামে পৌঁছনো দরকার। লালমুখো ইঁদুর যখন দেখা দেয়, তখনই মড়ক লাগে–পশুর দিকে চেয়ে মানুষের কতকিছু জানতে হয়। মানুষের মড়কের সংবাদ বহন করছে লাল ইঁদুর–একথা লোটা নিশ্চয়ই জানত! সে জেনেশুনেই, ইঁদুরের সংকেত পেয়েও, রাজা হিতেন রিবিকাকে ছিনিয়ে না নিয়ে, লোটাকে বধ না করে ফিরে যেতে চাইল, পারল না–সমস্ত সংকেত জানা ছিল–সংকেত পেয়েই লোটা লাফিয়ে চড়ল ঘোড়ায়। ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। এভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল লোটা। লোটা শেষ হয়ে গেল।
–এখান থেকেই তোমাকে শুরু করতে হবে সাদইদ। ঠিক এখান থেকে। চমৎকারভাবে বলে উঠল স্থপতি হেরা–নিনিভের নির্মাতা।
একথা শুনে তামাম প্রত্যঙ্গ বিপুল এক বেগে, হৃদয় এক মহাভাবে আন্দোলিত হতে লাগল সাদইদের। এই মরুমর্ত কী নিঃসীম তৃষ্ণা জাগায়–এ তৃষ্ণা জলে মেটে না। নারী, শিশু এবং শিল্পেও মেটে না–একটি প্রজাপতির ইন্দ্রধনুর রঙেও সেই তৃষ্ণা ছড়ানো থাকে–এই বাঁচা যে কী, কেউ জানে না। লোটা যেভাবে মরে পড়ে রইল, সেই তৃষ্ণার কী রূপ,কোন ভাষায় তা আঁকা যায় না। সে পৌঁছতে চেয়েছে; ফিনিসীয় বর্ণমালায় তার বিবরণ নেই, হাম্বুরাবির অনুশাসনফলকে তার হদিস নেই, আমারনার পত্রাবলীতে তার ঠিকানা মেলে না। উগারীতের সাহিত্যে, মেসোপটেমিয়ার কবিতায় তার কোন চিহ্ন খুঁজে পাবে না কেউ। তবু এখান থেকেই শুরু করতে হবে।
লোটার গায়ে হাত দিল সাদইদ। হিম। খাস স্তব্ধ। সে শিশুর মত মুখ গুজড়ে পড়ে ছিল। যেন সে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কেন এভাবে পড়ে থাকা লোটা? লোটা কোন উত্তর দিল না। এই পশুদল নিয়ে তুমি কী করতে, আমায় বলে দাও। তোমার অশ্ব রইল, যাকে নিয়ে তুমি একলা খেলা করতে। কত অপরাহু কত প্রভাত তুমি একলা খেলা করেছ, আমার বানানো ভাষা তোমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ভাষা পারে না। ভাষার উর্ধ্বে থাকে হৃদয়।
সাদইদ সহসা লক্ষ্য করে কালো অশ্বের কপালে একটি মাটির ফলক। ভাঙাচোরা নকশা আঁচড় কেটে কেটে তৈরি, খুবই পুরাতন নকশা, একজন রাজার ছবি, অনেকটা ফেরাউনের মত, পায়ের তলায় দেবী ইস্তারের নগ্নমূর্তি। এ দেবী রিবিকা ছাড়া কেউ নয়।
অপটু হাতে মৃত্যুর আগে একজন যাযাবর একে রেখে গেল। ফলকে হাত রেখে হেরার দিকে ঈষৎ বিস্মিত চোখে চেয়ে রইল সাদইদ। হেরা পানসে হেসে বলল–তোমার বন্ধু খুব উচ্চাশী ছিল মনে হচ্ছে। সে সারগন হওয়ার স্বপ্ন দেখত।
–না হেরা। আপনি নোটার অভিপ্রায় বুঝবেন না।
–কেন?
–-ও এঁকেছে ওর স্ত্রীর ছায়া। সে যেন তোটাকে স্বীকার করে। এতগুলো পশু নিয়ে সে ফিরছে, সে রাজা ছাড়া কী? কী আশ্চর্য! কোন দেবদাসী কখনও ওকে সারগন বলে ডাকেনি!
ক্রমাগত লোটার স্মৃতি মরু আকাশের ভাসমান মেঘের পতিত ছায়ার মত দিগন্ত ছুঁয়ে ছুটে আসছিল। কালো ঘোড়ার কপালে ঝোলানো ফলক লোটা পরম আহ্লাদে পথ চলতে চলতে সংগ্রহ করে উৎকীর্ণ করেছে। এ ফলক শিলার মত মসৃণ। সহজে আঁচড় পড়ে। অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সাদইদ হাতে ধরা ফলক ছেড়ে দিয়ে বলল–তাহলে এখান থেকেই শুরু!
হেরা বলল–একজন যাযাবর ঠিক এখান থেকেই শুরু করে কিনা! ফেরাউনের রাজসভায় এমন অনেক যাযাবর মন্ত্রিত্ব করেছে, যার হাতে উটের লাগাম ধরা ছাড়া ধরবার কিছুই ছিল না। লোটা যদি একজন চাষী হত, কখনও মড়কের শহরে পা দিত না। দুঃখিত সাদইদ, একথায় আমি কিন্তু তোমায় কোন ইঙ্গিত করিনি।
অসহায় আর করুণ চোখ দুটি তুলে সাদইদ হেরাকে বলল–তুমি শিল্পী তোমার তো অহংকার থাকবেই। স্ত্রী মরেছে মড়কে, শিশু হারিয়ে গেছে। তথাপি বাঁচালতার কোন কামাই নেই। ইহুদের অহংকার লাঠি, ফেরাউনের পিরামিড, তোমার অহংকার ছেনি, বাটালি। কিন্তু লোটা? ওর ছিল উট। এই কালো ঘোড়াটা ওকে আমি উপহার দিয়েছিলাম। ফলে উটের পূজারী কখনও। মাথা তুলে কথা বলত না। ওর ছিল সাহস–তাই সে মড়ককেও ভয় পায়নি। যাক গে। লোটার ঘোড়াটা এবার তুমি নাও। তোমায় দিচ্ছি।
হেরা কেমন অসহায়ের মত ব্যস্ত সুরে বলে উঠল–না না। ওটা তুমিই নাও । আমার এই সাদাটাই ভাল। বেশ আছি এটার পিঠে!
–ওটা ভাল নিশ্চয়। এটাও খারাপ না। তবে সাদাটা কিঞ্চিৎ বজ্জাত। তোমায় ফেলে দিতে পারে।
–না না। ফেলবে কেন! আমরা তো ধীরে ধীরে যাব। এতগুলো জীবকে তো খেদিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
–সে আমি দেখব’খন তুমি কালোটার পিঠে উঠে পড়।
–না সাদইদ । আমায় বিরক্ত করো না। বলছি তো সাদাটায় বেশ আছি।
–আমি যা দিতে চাইছি, তোমার তাতে আপত্তি কিসের?
কিয়ৎক্ষণ চুপ করে থেকে হেরা বলল-লোটার অশ্ব! ভেবে দ্যাখো, সেটা কী হতে পারে। তা ছাড়া লোটা অসুস্থ ছিল বন্ধু সাদ! মিতে তোমায় গোপন করব না–তোমার মিতবউ মড়কে মরেছে–একটা লাল ইঁদুর কী ভয়ানক। আমায় ওভাবে বারবার তাগাদা দিচ্ছ কেন? একটা অসুস্থ উট-উপাসক ভাড়াটে সেনা–মানে, তুমি ঠিক বুঝবে না, আমি কী বলতে চাইছি! ইঁদুর কী ভয়ানক। তা ছাড়া উট-উপাসক! মানে ঠিক তোমায়…