অত্যন্ত তীব্রভাবে লোটার কথা মনে পড়ে গেল। কোথায় গেল মানুষটা, কেনই বা ওভাবে হারিয়ে গেল! ওই প্রাণীটির কথা ভাবলে লোটাকেই শুধু মনে পড়ে না–কত ভাবনার উদয় হয়। মরুভূমির মানুষ তৃষ্ণার সময় এই প্রাণীটিকে হত্যা করে এর শরীর থেকে জলের থলি বার করে নেয়। বাঁচার জন্য এমন নৃশংসতার কথা একজন চাষী ভাবতে পারে না। একে না মারলে জীবন বাঁচে না।
বেঁচে থাকার এই নীতিই যুদ্ধের নীতি । মানুষ পশুর কাছে জীবন ভিক্ষা চেয়েছে হত্যার মাধ্যমে। এ ভিক্ষা নয়, অপর অস্তিত্বকে মুছে দিয়ে নিজেকে টেকানোর নামই যুদ্ধ। মানুষ যখন এভাবে বাঁচার শিক্ষা পায়–অন্য কোন উপায় ভাবতে পারে না, তখন যুদ্ধের নীতি হয়ে ওঠে আক্রমণলুঠ, হত্যা, বিনাশ। এই নীতি মানুষ তৃষ্ণা ও খাদ্যের বেলা যেমন পশুর উপর প্রয়োগ করে, তেমনি মানুষের উপরও প্রয়োগ করে।
এই নিয়মের বাইরে কি কিছু নেই? হিতেনকে হত্যা না করলে কি লোটার বাঁচা হয় না! লোটাকে না মারলে কি হিতেনের বাঁচা অর্থহীন হয়ে যায়। একটি নগর ধ্বংস না হলে কি আর একটি নগর গড়ে ওঠে না। জীবন কি মরুভূমি মাত্র! অঞ্জলিবদ্ধ হাত জলে ছোঁয়ানোর সময় সাদইদ লক্ষ্য করছিল উটটি সমান তালে মুখ নামাচ্ছে জলে।
উটের কোন গৃহ নেই। তাঁবুর পাশে তার নগ্ন আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে ঝিমোতে থাকা কাঠামো–সে শূন্য মরুভূমির উপর দাঁড়িয়ে থাকে একা। লোটা যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকত। উটকে মানুষ একটি কুকুর কি অশ্বের মত ভালবাসে না। তাকে ঘর দেয় না। স্নেহ দেয় না। তৃষ্ণার জল নেয়। হত্যা করে। তার পিঠে রতিবিহার করে। উটের কাঠামো শিল্পহীন, অশ্বের মত তার দেহে আকাশ ঝিকিমিকি বিদ্যুৎ নেই।
চাঁদ না হলে রাত্রি পার হওয়া যায় না। দিনে অশ্বারোহণ, রাত্রে বিশ্রামকতকাল এভাবে, আর কতকাল?–অন্ধকারে মুছে যাওয়া আকাশে চোখ তোলে সাদইদ। বহু দূরবর্তী এক নিঃসঙ্গ তারকা জ্বল জ্বল করে–যেন লোটার চোখ। সাদইদের এত কষ্ট হচ্ছিল যে,বুক ভেঙে পড়বে মনে হচ্ছিল। উটটা মরূদ্যান ছেড়ে অন্ধকার মরুভূমিতে নেমে চলে গেল–যেন একটি কবর ভেসে গেল, মানুষের মৃত্যু-গহ্বরের ভূপ। এই গহ্বরে তলিয়ে গেছে নগরী নিনিভে।
একজন চাষী ফলবান বৃক্ষের কাছে যা শেখে, একজন মরুভূমির যাযাবর তা কখনও শিখতে পারে না। গাছ মাটির তলে ‘আপন হৃদয় দিয়ে চিন্তা করে। নিজেরই জ্ঞানে শেকড় চালিয়ে দেয় রস টেনে নেয় দেহে, পাতার আড়ালে রচনা করে পুষ্প, দিয়ে তৈরি করে রসালো ফল। গাছ কোথাও যায় না। সে চুপচাপ ফুল ও ফল তৈরির ধ্যান করে, শেকড় ক্রমশ প্রসারিত করে। নিঃশব্দে–সে কখনও হুংকার দেয় না, আর্তনাদ করে না অযথা। একজন চাষী তাই কোথাও যেতে চায় না–সে ফোঁটাতে এবং ফলাতে ভালবাসে। অথচ রাজারা, দাসমালিকরা নগর গড়বার জন্য তাদের জমি থেকে উৎখাত করে নিয়ে যায়। কপিকলে জুড়ে দেয়। আর একজন যাযাবরকে পাকড়াও করতে পারলে মিশরের রাজা পিরামিড বানানোর পাথর বহন করিয়ে নেয়–তারা কবরের পাথর টানে উটের পিঠে করে। অথচ লোটা বৃক্ষের মত একটি নারীর ছায়ায় আশ্রয় চাইত।
অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে রিবিকার মুখটা, তার নগ্ন প্রজাপতির ছবি মনে পড়ে গেল। দিনের পর দিন ধূসর দিগন্তহারা মরুভূমি মানুষকে কী দিতে পারে? না কোন শিল্প, কোন বৃক্ষচরিত্রহায় প্রজাপতি!
আবার ভোরবেলা মরুভূমির বুকে নেমে এল হেরা আর সাদইদ। এভাবে ওরা কতদিন চলেছে খেয়াল ছিল না। কিন্তু মরুভূমি আজ আর দৃশ্যহীন নয়। একটি স্থির ছবি যেন অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। প্রায় স্থিরই বলা যায়। গরুবাছুর ছাগছাগী মেষ গাভীর দল অল্প অল্প লেজ নাড়ছিল বৃক্ষগুলির ছায়ার নিচে। বড় গাছটির তলায় মুখ খুঁজড়ে পড়ে আছে শিকড়ের আড়ালে একজন। যেন কোন মসীহ।
মুখটা শিকড়ের ভিতর গোঁজা। এতগুলি পশু নিয়ে লোকটা কোথায় যাচ্ছিল? পরনের কাপড় শতচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। চাষীর মতই খালি গা। খুব মেহনত করেছে বোঝা যায়। কিন্তু ওভাবে শুয়ে আছে কেন? নিনিভে থেকেই লোকটা দূরপাল্লার পথে নিশ্চয়ই যাত্রা করেছিল। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছে। যেন মসীহ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
সাদইদ ডাকল–অ্যাই শুনছেন! ওহে, এদিকে একবার দেখুন?
মুখ গোঁজা বেচারি কোনই সাড়া দিল না। এমনকি নড়ল না অবধি। সাদইদ বার কতক ডাকার পর ঘোড়া থেকে নেমে এল। ঠিক তখনই কোথা থেকে ছুটে এল কালো অশ্বটি। দ্রুত পড়ে থাকা মানুষটির গায়ে মুখ রেখে অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে রইল। অশ্ব স্থির। যেন সে শ্বাস নিতেও চাইছে না। সাদইদ অশ্বটিকে চেনবামাত্র মুখ গোঁজা লোটার কাছে ছুটে গেল। ঘোড়া সাদইদকেও চিনতে পেরেছিল। গা ধরে মুখটা চোখের উপর টেনে আনল সাদইদ। কষে রক্ত গড়ানো ফর্সা মুখ নির্বাপিত, পীতবর্ণ। ক্ষণকাল আগে রক্তাভায় জুলজুল করছিল, ঠোঁট কালো হয়ে গিয়েছে–দু চোখ মুদিত। লোটা জীবিত নেই। এভাবে অবশেষে এইভাবে দোস্ত!কথাগুলি উচ্চারণ করতে গিয়ে অভিমানী শিশুর মত সাদইদের ঠোঁটদুটি প্রবল আবেগে থর থর করে কেঁপে উঠল।
হেরা বলল–আকছার এমনটা ঘটছে সাদইদ! নিনিভের অভিশাপ আছে, সে পৌঁছতে দেয় না। দ্যাখো, একটু দূরেই তো গ্রাম শুরু হয়েছে! অথচ বেচারি আর যেতে পারল না। কত মানুষ এরকম রাস্তায় পড়ে রইল তার ইয়ত্তা হয় না।