সাদা অষের পিঠে হেরার পুত্রকে কোলে করে ছুটে এসেছে সাদইদ। তার মনে হল, সামনের এই ছবিই পৃথিবীর শেষ ছবি। এর চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। তার দেখা প্রজাপতি অধিকৃত নারীই লোটার বুকে আরো সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে। এবং এর পরই পৃথিবীর নৃশংসতম দৃশ্যটি সে দেখবে।
কিন্তু দৃশ্যান্তর হল ইয়াহোর নির্দেশে। কেননা মহাত্মা আকাশে মুখ তুলে ইয়াহোর নামে আতশব্দ করে উঠলেন মুহুর্মুহু ।
দিগন্ত সহসা কালো হয়ে উঠল। মনে হল দিগন্তজুড়ে কী যেন কালো মতন ভেসে আসছে। রাজা হিতেন সুন্দরী রিবিকাকে ধরবার জন্য রথ ছেড়ে নেমে পড়েছিল। সে কেবল সম্মুখে এগিয়ে এসেছে মাত্র দুটি ধাপ ফেলে, এমন সময় দিগন্ত সমাচ্ছন্ন হল! অজস্র ঈগল নিনিভের দিক থেকে উড়ে আসছে।
প্রত্যেকটির পায়ে ধরা ইঁদুর। মাথার আকাশ ভরে গেল মুহূর্তে।
রাজার পায়ের কাছে ঈগল তার শিকার ফেলে দেয়। ইঁদুরের মুখ টুকটুকে লাল। পেট মোটা। ধপ ধপ শব্দে ইঁদুর পড়তে থাকে আকাশ থেকে। মানুষ আর্তনাদ করে ওঠে–মড়ক! মড়ক! মানুষের মড়ক! নিনিভে মানে মড়কের নগরী! সব শেষ হয়ে গিয়েছে।
রাজার দেহ সঙ্গে সঙ্গে হিম হয়ে যায়। সে হাত বাড়িয়েছিল কিন্তু পা আর নড়াতে পারল না। রাজা রথে গিয়ে চড়ল।
মহাত্মা ইহুদ লোটার দড়ি গা থেকে দ্রুতহাতে খুলে দিলেন। লোটা ছাড়া পেয়ে তার কালো অর্থের দিকে দৌড়ে গেল। সমস্ত মরুভূমিতে পা ফেলা যাচ্ছে না। ভয়ে রাজার সৈন্যরা অশ্ব ছুটিয়ে দিয়েছে অন্য দিগন্তের দিকে। পা আর ফেলা যাচ্ছে না কিছুতেই। প্রচুর ইঁদুর দৌড়চ্ছে। লাল মুখ। পেট ফোলা। কোনটির ভুড়ি বেরিয়ে পড়েছে। লোটা লাফিয়ে উঠল কালো ঘোড়ার পিঠে।
তেড়ে গেল রথ লক্ষ্য করে। রাজার বুক ভেদ করে গেল লোটার ছুঁড়ে দেওয়া বর্শা। রাজার দেহ রথ থেকে মাটিতে পড়ে গেল। তারপর এক দণ্ডে কালো অশ্ব কোথায় হারিয়ে গেল দেখা গেল না।
সমস্ত রাত কম-বেশি সকলেই জেগে থাকল লোটার অপেক্ষায়। লোটা এই বুঝি ফিরে আসে। সবাই ভয় করছিল সমস্ত মরুভূমিতে লালমুখো মড়কের ইঁদুর ছড়িয়ে গেছে। জুম পাহাড়ী এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া দরকার। মহাত্মা ইহুদ রাত্রির আকাশে আর্তনাদ ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন মাঝে মাঝে ইয়াহো!
মানুষের হৃদয় সেই আর্তনাদে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। তারা শেষ রাত্রের লাল চাঁদের আলোয় দিগন্তে চেয়ে ভাবছিল–একটি কালো অশ্ব তারা দেখতে পাবে। সমস্ত রাতের প্রতীক্ষা ব্যর্থ করল লোটা। ফিরে এল না। মহাত্মা ইহুদ ভোরের সূর্যকে লাঠি তুলে শাসন করে বললেন–হ্যাঁ সামাশ! তুমি আবার এসেছ! তোমাকে ইয়াহোর নির্দেশে বারবার আসতে হবে! রানী ইসাবেলা তুমি দেখে যাও, ইয়াহোর হুকুমে শত শত ঈগল উড়ে এসেছে। সূর্য এসেছে। লোটা তাঁরই নির্দেশে হারিয়ে গেল! ইয়াহো চাইলে সে আবার ফিরে আসবে! নতুবা সে আর ফিরবে না। চলো আমরা মধুদুগ্ধের দেশে যাত্রা করি!
রিবিকা এ সময় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সকালের দিগন্তে চেয়ে থাকতে থাকতে রিবিকার মনে হল, কালো ঘোড়া ওই বুঝি দেখা যায়! কিন্তু সে দেখল একটি সাদা অশ্ব দিগন্তে উদ্ভাসিত হয়েছে। সে তখন আরো জোরে কেঁদে উঠল উচ্চকিত সুরে।
এরপর সব প্রবল প্রবাহ এল নানা দিগন্ত থেকে। মহাত্মা প্রস্তুত। বিশাল এক জনসমুদ্র মহাত্মাকে অনুসরণ করবে। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। সূর্যের কুসুম আলো লাল বালুতে পড়ে জ্বলজ্বল করছে। জুম পাহাড় একা দাঁড়িয়ে আছে। তার ভাষা কেউ আর শুনবে না।
সাদা অশ্ব থেকে ছেলে কোলে করে নেমে এল সাদইদ। তার চোখে সমস্ত রাত্রির জাগরণ। সে লোটাকে খুঁজে ফিরেছে তামাম রাত্রি। সাদইদ মাথা নিচু করে রিবিকার দিকে শিশুকে এগিয়ে ধরে বলল-একে বাঁচিয়ে রেখো রিবিকা। আমি লোটাকে খুঁজতে গেলাম।
জনস্রোত চলতে শুরু করল। রিবিকা হঠাৎ শিশুকে কোলে নেবার সময় লক্ষ্য করল সাদইদের হাতের উল্কি রক্তাক্ত, সদ্য ছুরিতে কেটে ফেলেছে সে। রক্ত ঝরে পড়ছে। সাদইদ চিৎকার করে উঠল
–কেউ তোমরা আমার সঙ্গে যাবে না? অন্তত একজন কেউ? আমার ভাষায় যারা কথা বলেছ, তারা কেউ নেই?
০৭-৮. জুম পাহাড়
জুম পাহাড় কোন উত্তর দিল না। আমার সমন্বয়ী অরমিক ভাষায় যারা কথা বলেছ, তারা কেউ নেই। আর্তনাদ করেছিল সাদইদ। তার নিজস্ব পাহাড়ও কোন জবাব দেয়নি। শিশুর গলার লকেটটি সে ঝুলিয়ে রেখেছে সাদা অশ্বের কপালে। এই চিহ্ন ছাড়া জুম পাহাড়ী জীবনের আর কোন অবশেষ নেই। কোন দিগন্তেই লোটার সাক্ষাৎ মেলেনি।
ঈগল উড়ে আসা যত অলৌকিক, তারও চেয়ে রহস্যময় লোটার হারিয়ে যাওয়া। সে যেন পয়গম্বরের মত কোথাও চলে গেছে। মৃত রাজার নাকের কাছে একটি লাল ইঁদুর মরে পড়ে আছে। রাজার নাকের ভিতর ইঁদুরের গা থেকে নেমে চলে গেছে লাল পিঁপড়ের একটা স্রোত। রাজার এই মৃত্যুও অলৌকিক।
প্রজাপতির রেণুর মত তুচ্ছ এ জীবন রাজা! বিড়বিড় করে একলা নিঃসঙ্গ মরু-যাযাবর সাদইদ বলে উঠল। গাছের ডালে বসে থাকা কালো ভয়ংকর ঈগল ছাড়া সেকথা কেউ শুনল না। দিগন্তে মিলিয়ে গেছে মহাত্মা ইহুদের জনতা।
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল সাদইদ। তারপর নিনিভের দিকে অশ্ব হাঁকিয়ে দিল। চলতে চলতে সহসা তার দ্বিতীয় শিক্ষা শিবির, যেখানে সে আটাশ জন সৈন্য রেখে এসেছিল, যেখানে রয়েছে কিশোর সমেরু, মনে পড়ল সেকথা। সেখানে রয়েছে ক্ষুদ্র অরণ্য,সমুদ্রের হাওয়া সেখানে তবু লাগে–এখানেই সে রিবিকাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। শিবিরের ভিতর ঢুকে পড়ল সাদইদ। তাঁবুতে সামুদ্রিক হাওয়া এসে লাগছে। তাঁবু ফটাস ফটাস করে ক্রমাগত শব্দ করছে। যেন কোন ডানাঅলা প্রাণী।