‘অত্যাচারী তার পাপের ভারা টানতে পারে না। তার স্পর্ধাচিহ্ন পিরামিডের চুড়ার মত আকাশম্পৰ্শী হলেও সে ডোবে।‘
এই লিপি হুবহু সুমেরীয় লিপির অনুকৃতি নয়। তার সঙ্গে আধুনিক মেজাজ এবং মিশরীয় উপমা ব্যবহৃত হয়েছে। সেদিকে আঙুল তুলে ইহুদ বলেছেন–এই লিপি ইতিহাসজড়িত। কিন্তু মিশরের রাজা এতে ক্ষুব্ধ হতে পারেন। প্রাচীন অনুশাসন অবিকৃত রাখাই বিধেয়। তোমরা এভাবে প্রকাশ্য উক্তির নকশা না আঁকলেই পারে। তাছাড়া দেবী ইস্তারকে এভাবে গহনা পরিয়ে জীবিত করার মানে নেই। এ দেবী নগ্ন ছিলেন। এসব কুসংস্কার।
ইহুদেরও দেবীর উপর রাগ। কিন্তু তিনি খুব বুদ্ধিমান। সব কথাই খুব নরম সুরে বলেন। তিনি জানেন পর পর সাত বছর দুর্ভিক্ষ হলে মানুষ কৃষির দেবী, উর্বরতার বিগ্রহ ইস্তারকেই ডাকবে। নগ্ন হলেও ডাকবে । ইহুদের বোঝা উচিত, কেন, কীভাবে দেবী নগ্ন হয়েছিলেন!
রিবিকার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। সে তখন জলের তলায় হাত চালিয়ে দিয়ে শব্দ করল। জলের শব্দে হায়েনাটা আবার সরে গেল। যেন মৃত্যুর ছায়া সরে গেল চকিতে।
তার মনের ভিতর জেগে উঠল তিনটি লোম-ছাঁটা ভেড়ার করুণ নেড়া ছবি। একজন কনানীয় চাষী রিবিকাকে বিক্রি করছে। মেষের লোম স্থূপীকৃত করেছে একজন যাযাবর মেষপালক বণিক। মদের কারবারী। লোকটির হাতে ধরা লোমকাটার যন্ত্র। খুরপি চকচক করছে। আক্কাদের গাধাগুলির পিঠে ছিল চামড়ার থলে ভর্তি মদ আর শুঁটকি মাছ। সেবছর মরুভূমির হাহাকার করা শীত ছিল কনানের গ্রামগুলিতে–সে যে কী ভয়ংকর দুর্দশা!
মরুভূমিতে শীত সব বছর সমান পড়ে না। এই শীতকে চাষীরা যমের চেয়ে ভয় পায়। মেষপালক যাযাবর আব্রাহামীদের সেকারণে রেয়াত করতে বাধ্য হয় তারা। যাযাবরী তাঁবুগুলির সঙ্গে সেই সময় সদ্ভাব হয়। ভেড়ার নোম আর যাযাবরীদের হাতে বোনা লোমের পোশাক চাষী তার শস্যের বিনিময়ে কেনে। ঘটনা এমনও রয়েছে যে,একটি গরিব চাষী পরিবার শুধুমাত্র নোম পাওয়ার জন্য যাযাবরীদের চাষের জমিতে বসবাসের সুযোগ দিয়েছে। চাষবাস এবং অন্যান্য কাজের সুযোগ দিয়েছে। দ্রাক্ষাচাষ এবং মদ তৈরি শিখিয়েছে।
নগরের লোকেরা আব্রাহামীদের কেন যে বেদে বলে উপহাস করে? অমার্জিত অসভ্য বলে কটুক্তি করে? খুরপি-অলা আক্কাদের চোখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বালিকা রিবিকার দুই চোখ ম্লান হয়ে আসছিল। দুই চোখ তার বারবার ভিজে উঠছিল। ঠাকমার মুখে রাজা সারগনের গল্প শুনেছে । তিনি ছিলেন রাজচক্রবর্তী। এই আক্কাদের পূর্বপুরুষ তিনি। ফোরাত আর হিদ্দেকল নদীর তীরে ছিল তাঁর রাজপ্রাসাদ ‘জিগুরাত’ সে এক স্বপ্নবেষ্টিত পৃথিবী। আজ আর নেই। কেন নেই, সে এক অভিশাপের কথা। সে কাহিনী শুনলে মন খারাপ করে।
মানুষ রাজত্ব গড়ে, ফের রাজত্ব হারায়। আব্রাহামীদের বদনাম ঘোচে না–এরা মরু আরাবার হানাদার গোষ্ঠী। এরা বেদে। এরা নিরন্ন। দিদিমা সুর করে বলতেন :
‘আব্রাহামী হানাদার মাথা নিচু করে না,
সারগন মরে তবু সারগন মরে না ॥
নলখাগড়ার ঝুড়িতে সারগন ভাসে রে;
পীচ-আঁটা ঢাকনার ঝুড়িতে–
জর্দন নদীতে, ফোরাতের কূলেতে,
ভিস্তির কোলেতে সারগন হাসে রে ॥
তার জাত আরাবার, কাঁচাখেকো হানাদার–
বেঁচে থাকে তাঁবুতে, ঘরবাড়ি জোটে না,
যখন সে মরে যায়, কাঁচা খায় হায়েনা ॥
কবর তো জোটে না, তিন হাত জমিটুকু
তাও সে পায় না, এমনই হাহাকার–
হানাদার হানাদার, জর্দন নদীতে ফোরাতের কূলেতে ॥’
কোথায় ফোরাত আর কোথায় জর্দন! সারগন কতদূর পূর্বে পশ্চিমে উত্তরে দক্ষিণে সাম্রাজ্য গড়েছিল–সবই নিশ্চিহ্ন হয়েছে। পরে তারই জাত মিশরের ফেরাউনের হাতে বন্দী হল। সবই কপাল! এই আহাদী আক্কাদ তাকে আজ পশুলোমের বিনিময়ে মদ আর শুঁটকি মাছের বিনিময়ে খরিদ করছে বালিকা সে, তার বাধা দেবার কোনই ক্ষমতা নেই। তাকে বেচে নানী এই চাষী পরিবার। মরুভূমির শীতের হাত থেকে বাঁচবে। একটি পারিবারিক উষ্ণতার বিনিময়ে রিবিকা মধুদুগ্ধপ্রবাহিণী পবিত্র জন্মভূমি ছেড়ে কোথায় ভেসে যাবে।
আক্কাদ লোম কাটতে কাটতে হাতের খুরপি থামিয়ে ঘাড় তুলে বলল–ফোরাতের পানি তো খাওনি বাছা! দেখবে কী মিঠে! ফোরাতের হাওয়া খুব ভাল। আমার বাড়ির নাম হাওয়ামহল। খালি বসন্তের হাওয়া বয়। মরুভূমির ঠাণ্ডা পোঁছয় না। খুব তাড়াতাড়ি তুমি যুবতী হতে পারবে।
–আমি যাব না ঠাকমা! আমি কি আক্কাদের ভেড়ার চেয়ে দেখতে খারাপ!
–না বাছা! কিছুতেই না! তুমি যে খুবই সুন্দরী মাগো!
–তবে এভাবে বেচে দিচ্ছ কেন?
–তোমার ভাগ্য মা! আক্কাদের তোমাকেই চোখে ধরল কিনা! এই দ্যাখো, উনি আমাকে একখানা কুর্তা দিয়েছেন। তোমার কাকাদের লোমের জোব্বা দিয়েছেন। তোমার কাকীদের গরম বসন দিয়েছেন। সবই তোমার জন্য মা! জমিতে ভাল ফসল হলে তাই বেচে একটা উট কিনে তোমায় আনতে যাবে তোমার ছোটকাকা। ততদিনে তুমি আর কতটুকু বড় হতে পারবে–যদি বৃষ্টির দেবতা চোখ তুলে চান–সামনের সন তুমি ফিরে আসবে।
–তুমি যে বল, পূর্বদেশে যারা গেছে, তারা আর ফেরেনি!
–তারা তো যুদ্ধে মরেছে। তাছাড়া মিশরের রাজা ধরে নিয়ে গেছে। বিহিস্তুনের ডাকাতেও মেরেছে ওদের। তা ফের কারুকে ভান হ্রদে পুঁতে দিয়েছে। তুমি যাবে নিনিভে নগরী পার হয়ে, ফোরাত কি হিদ্দেকলের ধারে–সেখানে উটকণ্ঠী নৌকা ভাসছে মা। ভয় পেও না। মহপিতা পুণ্যশ্লোক নোহ তোমার সঙ্গে রইলেন!