চাঁদের আলোয় হঠাৎ খেয়াল হল, ঠিক পায়ের কাছেই একটি অর্ধমৃত কূপ। নিচে নেমে বালি সরাতে পারলে জল পাওয়া যাবে। তৃষ্ণার পীড়নে বুক ফেটে যাচ্ছে। আর দেরি না করে রিবিকা গড়াতে গড়াতে কৃপের তলায় নেমে আসে। ক্লান্ত হাতে বালি সরাতে সরাতে মরু-দস্যুটির কামানো থুতনি আর ঝোলা গোঁফ মনে পড়ছিল। তাকে দেখাচ্ছিল আক্কাদের সাদা আর গায়ে হলুদ মুতমাথা গাধাটার মত বোকা। নিশ্চয়ই পাহাড়ী ডাকাত। একটা হিত্তীয় বাঁদর। একেবারে গোঁয়ার হাটুস। হিটাইট বা হিত্তীয় জাতিকে মনে মনে হাটুস বলে গালি পাড়তে পাড়তে বালি খুঁড়ে চলল রিবিকা। আঙুলে জলের ছোঁয়া লাগা-মাত্র সে শিউরে উঠল। যেন-বা ফেরাউনের দৈবী হৃদয় পালক আর ঐশ্বর্যময় জীবনের মত তাকে ছুঁয়েছে। উপরে চাঁদের আলোর হালকা হাওয়া বইছে। দূরের অরণ্যে কোথাও পাতাগুলি নড়ে উঠল। এই সময় মরুভূমির পশুরা বালির উপর খেলা করে। উপর থেকে হাওয়ার একটা গোলা বয়ে এসে কূপের ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই বাতাসে পশুর গায়ের রমণ করা গন্ধ।
নিঃশ্বাস টেনে কেমন বিপন্ন হয় রিবিকা। জলপান করতে করতে ভাবে, ঈশ্বরের রমণকৃত সুঘ্রাত শ্বাস দিয়ে মানুষের জন্ম। এই জল, এই জ্যোৎস্না, এই বায়ু, উপরের বন্যঘ্রাণ, মাতাল মরুভূমি, রক্তঝরা মৃত্যুশীতল বালকা–অবধিহারা তার বিস্তার–অথচ সে এক ভাগ্যতাড়িত ক্রীতদাসী কিনা মুক্তির কথা ভাবছে–যে কিনা দেবী ইস্তারের মত নগ্নিকা। কী তুচ্ছ এই জীবন!
উপরে কৃপের কিনারে ভয়ংকর সেই লম্বাটে মৃত্যুবৎ জঘন্য-দর্শন মুখটা ঝুঁকে আসে। হিংস্র আর ধূর্ত মরু-হায়েনাটা কিছুতেই যাবার নয়। রিবিকা জলের ভিতর হাত নেড়ে খলবল শব্দ করে, খুব দ্রুত এবং সবেগে হাত নাড়ে। ক্রমাগত হাতের আন্দোলনে জলের চাপা অদ্ভুত শব্দে হায়েনাটা দূরে কান পাতে এবং মরুভূমির আকাশে তাকায়। জলের শব্দ থেমে যেতেই আবার ঝুঁকে আসে। রিবিকা অতর্কিতে পাথর মেশানো বালি ছুঁড়ে মারে। ভেজা দলা পাকানো বালি গিয়ে লাগে হায়েনার জ্বলন্ত চোখে। পশুটা অন্ধের মত চিৎকার করে ওঠে। হিংসার বিদ্যুৎ গলা থেকে খেঁকিয়ে বার হয়। গায়ে মোচড় মেরে পালিয়ে যায় পশুটা।
অতঃপর কুপের তলার জলে রিবিকার হাতে আন্দোলিত জল মাত্রই যে-শব্দ ওঠে, তাতেই ভয় পায় হায়েনাটা। সমস্ত রাত্রি এভাবে কূপটা জেগে থাকে। জল, মানুষ, চাঁদ আর হায়েনা ছাড়াও নাঙা দেবী ইস্তার জাগেন।
কাল ভোরে কী হবে, কোথায় যাবে রিবিকা কিছুই জানে না। সেকথা ভাববার মত মনের অবস্থাও তার নয়। সে কেবল এই রাতটুকু কোনভাবে পার করতে চায়।
নীল নদীর দক্ষিণ প্রান্তে এলিফেনটাইন (ঐরাবত দুর্গ)। দুর্গটি ধ্বংস হয়ে গেল। ইহুদের জনগোষ্ঠী নিরাশ্রয় হল। তার আগে পর পর সাত বছর নীল নদীতে জলোচ্ছ্বাস হল না। দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। স্বাভাবিকের চেয়ে মাত্র পাঁচ ফুট নিচে দিয়ে জল বইলেই নীল নদীর অববাহিকা অঞ্চলে ফসল জন্মানো যায় না। মাটি শুকিয়ে ওঠে। পর পর সাত বছরের খাদ্যাভাবে প্রচুর মানুষ মারা গেছে। ইহুদের যাযাবর গোষ্ঠীর পশুরা মরেছে। মিশরে ইহুদের লোকবল অতি সামান্য। অথচ সামান্য এই জনগোষ্ঠীর জন্যই ইহুদের স্নেহ অসামান্য। তিনি চান পারস্য উপসাগরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণ থেকে লোহিত সাগরের কিনারা পর্যন্ত বিস্তৃত হাজার মাইলের চন্দ্রকলাকৃতি অর্ধবৃত্তাকার ভূভাগের আধিপত্য। তাঁর ধর্মের বিস্তার। এবং তিনি আব্রাহামের বায়োগোষ্ঠীর একতা যাতে হয়, সেই ইতিহাস সৃষ্টি করতে চান। তাঁর বারোটি গোষ্ঠী চন্দ্রকলাকৃতি ভূভাগে ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের তিনি খুঁজছেন।
ইহুদ কবেই (ঐরাবত) এলিফেনটাইন ছেড়ে চলে যেতে পারতেন। দুর্গের চারপাশ ঘিরে গড়ে ওঠা রিবিকাদের বস্তীগুলিকে তিনি এক পরম মমতাবশত ত্যাগ করে যাননি। তাঁর সংকল্প ছিল মোসির উল্লিখিত নিশান-মাস অর্থাৎ মুক্তির মাসেই যাত্রা করবেন কানের দিকে। ঠিক এই মাসেই মাত্র ৮০ জন উৎকৃষ্ট উম্মত পরিবার সঙ্গে করে মোসি এই মিশর ছেড়ে গিয়েছিলেন একদা অতীতে। কিন্তু একদিন (১২০০-৫২৫ খ্রিঃ-পূর্বাব্দের কোন এক সময়) ইতিহাসের চাকা অতীতবৃত্তে ঘুরে যেতে লাগল পিছনে, ঘুরেই গিয়েছে বলা যায়। মিশরীয়রা মোসির আগের যুগের মত বিভিন্ন স্থান থেকে ইহুদের ধর্মের লোকজনকে কিনে। এনে, জোর করে ধরে এনে ক্রীতদাস ব্যবস্থার নতুন করে পত্তন করেছে এই মিশরের বুকে। দক্ষিণ-পূর্বের অসুর জাতি মিশর আক্রমণ করেছে অতীতের মত।
অবশ্য মোসি তো মাত্র ৮০ জন উম্মত পরিবারকে কনানের দিকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। পরে সেই টানে আরো কতজন বিভিন্ন স্থানে মুক্তি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু দাসত্বের শৃঙ্খল বারবার পায়ে পরেছে তারা। কেবল একটুখানি মুক্তির স্বাদ তাদের রক্তে মিশেছিল সেই কবে। সেই স্বাদ আবার তারা ভুলে যেতে বসেছে। যাযাবর জাতি স্বাধীন চৈতন্যে ঘোর, ফের মাটির টানে তার রক্ত উষ্ণ হয়, ক্রীতদাসত্বে মজে। হানাদার হিসেবে তার বদনাম যত, মুক্তি-পিপাসু এবং ভূমিবশ্য হিসেবেও তার রক্তের গড়নের দাম আছে। ইহুদ এসব বলেন।
এলিফেনটাইন (ঐরাবত) কতবার ধ্বংস হয়েছে। দুর্গের মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেছে ক্রীতদাসেরা। বিশেষত মেসোপটেমিয়ার আব্রাহামী দাসেরা চেয়েছে মন্দিরটি পুনরায় নির্মাণ করে সাজাতে এবং দুর্গের প্রাচীর খাড়া করতে। অতঃপর দেবী ইস্তারকে মন্দিরের সর্বোচ্চ ধাপে প্রতিষ্ঠা দেবার চেষ্টা করেছে। তারা। এমনকি তারা মন্দিরের গায়ে খোদিত করেছে মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন অনুশাসনলিপি। মানবাধিকারের জ্বলন্ত উক্তি।