চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পায়ের তলার ভেজা বালি পাথর আর জল মুঠো করে চেপে ধরল রূপবতী রিবিকা। রিবিকার গায়ে কাপড় নেই। পরনের কাপড়খানিও মরুদসুর হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে। আকাশের নীল নদীর জলের মত উজ্জ্বল চাঁদ নগ্ন রূপসীকে দেখছে, কিন্তু নির্বাক। আকাশের ওই ক্রীতদাসী চন্দ্রমা কী বলবে তাকে? রূপ আছে কিন্তু নরদেবতা ফেরাউনের পিরামিডের আকাশ ছেড়ে কোথাও চলে যাওয়ার সাধ্য নেই। যেন সে পিরামিডের চুড়োর সঙ্গে গাঁথা। নরদেবতা সপ্তম ফেরাউন তাকে আটকে রেখেছে। তার বন্দিত্ব আর রিবিকার বন্দিত্ব নীল নদীর আকাশের মত সীমাহীন অথচ তা যেন-বা একটি পিরামিডের চূড়ার চারপাশে বন্দী।
একটি হায়েনা এসে মরুকূপটির উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে রিবিকার হৃদয় কেঁপে উঠল। মানুষ নাকি হৃদয় দিয়ে চিন্তা করে–একথাই বলেন নরোত্তম ইহুদ। সেকথা যদি সত্য হয়, তাহলে এখন সেই হৃদয় স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। পায়ের তলায় জল পাথর আর বালি ফের মুঠো ভরে আঁকড়ে ধরে বিনিদ্র রিবিকা। তারপর সে কূপটির তলা থেকে সেই ভেজা ভারী পাথর মিশ্রিত বালি উপরের দিকে ছুঁড়ে মারে। এই মরুকূপের ভিতর সে মরুদস্যুর হাত থেকে কোন প্রকারে প্রাণে বেঁচে আত্মগোপন করতে পেরেছে। উপরে দীর্ঘক্ষণ তাদের দলটির সঙ্গে দস্যুদলের লড়াই হয়েছিল সন্ধ্যার মুখে।
কেউ রক্ষা পায়নি। সকলকে হত্যা করেছে ডাকাতরা। কেবল সে লড়াই বাধার পর উটের পিঠ থেকে নেমে পালাতে শুরু করে। ঊর্ধ্বশ্বাসে মরুভূমির ভিতর দিকহারার মত ছুটতে শুরু করে। একজন ডাকাত তার পিছু পিছু তেড়ে এসে তার গায়ের পোশাক টেনে ছিঁড়ে দেয়। পরনের পোশাক ধরে টানাটানি করার সময় রিবিকা হতভাগ্য দেবী ইস্তারের নাম ধরে কঁকিয়ে কেঁদে ফেলেছিল। দস্যুটি তাকে কিছুতেই ছাড়ত না-সহসা কোথা থেকে একটি বর্শা এসে কামোন্মত্ত ডাকাতটিকে পিছন থেকে বিদ্ধ করে। লোকটি রিবিকার পরনের পোশাক ছেড়ে মরুভূমির বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে যায়।
আবার পালাতে থাকে দেবী ইস্তারের মত নগ্ন এবং রূপসী রিবিকা। কতদূর সে ছুটে এসেছে বুঝতে পারে না। যেন নীল নদীর পশ্চিম তীরে সূর্যদেবতা সামাশ ডুবে যাচ্ছেন, মরুপথ অতিক্রম করতে করতে বুঝতে পারে মাত্র–অথচ কোথায় সেই নীল নদী পড়ে রইল পিছনে। তার শস্য রাঙানো দেহতীরের বসতি ভেঙে দিল মানবদেবতা ফেরাউন–যে কিনা দুই-তৃতীয়াংশ দেবতা এবং মাত্র একাংশ মানুষ। ফেরাউনদের শবাধারলিপি সে পড়েছে। তাতে স্পষ্ট করে লেখা ছিল, চিরকাল তারা লিখে আসছে :
‘আমি কাউকে কখনও কাঁদাইনি,
আমি কাউকে কখনও কষ্ট দিইনি,
আমি পশুদের কখনও আঘাত দিইনি।
আমি কাউকে কখনও মৃত্যুদণ্ড দিইনি ।।‘
মরুপথে দিগ্বিদিক ছুটতে ছুটতে রিবিকা কতবার সেই শবাধারলিপি মনে মনে পাঠ করেছে আর দেবী ইস্তারের নাম ধরে কেঁদেছে।
বালির আঘাতে রিবিকার পা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, ফোস্কা পড়েছে। সে ছুটতে ছুটতে বালির ঢিবির পাশে পড়ে গিয়েছিল, শ্ৰমশ্রান্ত সে–তার হৃদয় আর চলছিল না। হৃদয় চিন্তা করতে পারছিল না। আস্কিলনের রাজকুমার ওয়িডিয়া হৃদয় দিয়ে চিন্তা করতেন। নরদেবতা ফেরাউন সেই হৃদয় দিয়েই চিন্তা করেছে। এমনকি পুণ্যশ্লোক ইহুদ অবধি হৃদয়ের সংকেতে কথা বলেন। কারণ এই সকল দিব্যজ্ঞানী মহাত্মাদের হৃদয় সত্যের পালক দিয়ে ওজন করেছেন ঈশ্বর–তাঁরা প্রত্যেকেই সত্যের এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। অথচ রিবিকা জানে না, পালকের মত হালকা আর কোমল তার হৃদয় ভেঙে পড়বে কিনা! তার হৃদয় আজ কোন্ সংকেত বহন করছে। সূর্যদেব সামাশ মরুভূমির বুকে অস্ত গিয়েছেন, চাঁদের বেগুনি আলো পড়েছে বালিতে, যা ক্রমে রূপার গলিত বিভায় উজ্জ্বল হবে, হৃদয় মাত্র এইটুকু চিন্তা করতে পারে।
কেমন এক আচ্ছন্নতার ভিতর, ক্লান্ত অবসাদের ভিতর রিবিকার সময় কেটেছে । চারিদিকে চাঁদের আলোর ঘোর। সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হলে চোখ মেলে রিবিকা। চাঁদ কোন দেবী কিনা জানে না সে, তবে ক্রীতদাসী যে সন্দেহ নেই। ইহুদের হৃদয় কি তবে সত্য বলেনি? কোথায় মুক্তি! মরুভূমির বালিতেই রিবিকা মুখ গুঁজড়ে পড়ে আছে।
ক্রীতদাসী চাঁদ জানে মাত্র তিনটি ভেড়ার লোমের বিনিময়ে রিবিকা দামাস্কাসের এক মরুবণিকের কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। অথচ সুন্দরী কনান তার মাতৃভূমি। পবিত্র দেশ কনান। আব্রাহামের মধুদুগ্ধপ্রবাহিণী স্বপ্নের দেশ, মহাপিত নোহের পিতৃভূমি। একজন বণিক, যার ছিল মদ আর লোমের ব্যবসা–রিবিকাকে তিনটি মেষের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়ে ফোরাত নদীর তীরভূমির দিকে চলে গিয়েছিল। সেই পূর্বদেশের দেবী ছিলেন ইস্তার। আকাশের দেবতা সূর্য,নাম তার সামাশ। অথচ সেই মেষপালক বণিকটি ক্ষুদে ব্যবসায়ী এবং চতুর–তাকে কন্যারূপে গ্রহণ করে, দাসীরূপে ব্যবহার করেছিল।
লোকটির নাম ছিল আক্কাদ। তার নবী ছিলেন সালেহ। সালেহ উটের নবী। পুণ্যশ্লোক ইহুদের মতই কি তিনিও মরু আরাবার নবী? নিশ্চয়ই তাই। ফোরাতের তীরে আক্কাদের ছিল ছোট একটি গোষ্ঠী।
সবচেয়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আক্কাদীয় গোষ্ঠী। মাত্র গুটিকতক তাঁবুর তলে তারা বাস করত।
কিন্তু এসব ভেবে তো কোন লাভ নেই। আক্কাদ অবশ্য ইট দিয়ে গেঁথে জমরুদ পাথর গেড়ে একটি সুন্দর ইমারত গড়েছিল–তার ছিল সাদা সাদা উট আর উষ্ট্রী। আর ছিল নানা রঙের মেষ। মদের দোকান ছিল।