কচি খেজুর রসের মত, নবীন সান্ধ্য রসের মত কৃষককন্যার গায়ের গন্ধ অসুরদের মুগ্ধ করে। যৌনতার এই মৌতাত তাদের সংগীতকে মাদকতায় পূর্ণ করেছে। মিশরীয়দের মত এরা ফুলের ঘ্রাণের উপমা প্রয়োগ করে না। ফোরাতের তীরেও একই ধরনের গান গাইত কিছু শ্রেণীর লোক। একটি খুঁটায় ঝোলানো নারীদেহ দেখে রিবিকার সেই গানের সুর মনে পড়ে। ভয়ে আর ত্রাসে সেই সুর পাখির ডানার মত মনের ভিতর ঝাঁপটায়-হৃদয়কে আঘাত করে।
রিবিকার দিকে পশুরা হিংস্র হলুদ চোখ মেলে তাকায়। রিবিকা ভয়ে অরণ্যের দিকে ছুটতে শুরু করে। ইহুদ কোথায় সে জানে না। খুটা পোঁতা পথ কতদূর গেছে সে জানে না। ইহুদকে সাঁজোয়ায় করে অসুররা তুলে নিয়ে গেছে কিনা তাও সে জানে না। ইহুদ চলেছিলেন পায়ে হেঁটে। তাঁর দল সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। রিবিকা হাঁটতে পারছিল না বলে দয়ালু ইহুদ তাকে উটের পিঠে চড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারপর উটের পিঠে ছিল আরো কিছু রমণী–তারাও আর নেই। উটের সঙ্গে পায়ে হাঁটা লোকেরাও নিশ্চিহ্ন, নিশ্চয়ই। তারা খুঁটায় ঝুলছে অথবা বালির উপরে শুয়ে আছে, বেঁচে নেই। হতে পারে অসুররা নয়, হিত্তীয়রা মেরে ফেলেছে।
এমন অরণ্যও এই প্রথম দেখছে রিবিকা। সমুদ্রের ভেসে আসা স্বল্প মেঘ এই অরণ্য রচনা করেছে। ক্ষুদ্র অরণ্য। দূর থেকে সমুদ্রের তান ভেসে আসছে। বৃক্ষপত্রের মর্মরধ্বনিও বেজে চলেছে। দেবদারুগাছ, ঝাউ আর শালসেগুনের গাছ, তাল খেজুর বীথি আছে, পাশেই রয়েছে দ্রাক্ষাকুঞ্জ। ফলবতী দ্রাক্ষা মৌমাছির পুঞ্জে গুঞ্জিত। একটি কৃষ্ণবর্ণ গাছের ছায়ায় আশ্রয় পায় রিবিকা। চারিদিক সৌরভে মুগ্ধ, আবিষ্ট। রক্তাক্ত নৃশংস মৃত মুণ্ডমালিকা-সজ্জিত পথ ছেড়ে এসেছে সে। রথ, অশ্ব, বর্শা, সাঁজোয়া, মরুকূপ, হায়েনা, শৃগাল শকুন–সেই ত্রাস এখানে নেই। দূরে রয়েছে মৌন সুদৃশ্য পাহাড়। অদ্ভুত স্তব্ধতা জমাট বেঁধে সৌরভ আর গুঞ্জনে ফুরিত করছে এক অপার সংগীত।
হঠাৎ রিবিকার চোখে পড়ল একটি বাচ্চা মেষ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কালো কুঞ্চিত কেশ সারা গায়ে, কিন্তু ছোট ঘোট। মেষটির বয়স খুবই কম। মরুযাত্রীরা ফেলে চলে গেছে। মরুদস্যুরা ওকে নেয়নি। রিবিকার অত্যন্ত মায়া হল। সে ওকে ধরবার জন্য হাত বাড়াল–আ মসীহ! বলে দু’হাত সামনে প্রসারিত করল রিবিকা।
হাতের নাগাল থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাণীটি। মনে হল একে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে সে। এই প্রাণীই তার নগ্নতাকে আড়াল করতে পারে।
এক দেবদাসীকে ভালবেসেছিল এক মিশরীয় যুবক। নমরুর জোয়ান পুত্র আবীরুদ। আবীরুদ রোজ মন্দিরের চারপাশে ঘোরাঘুরি করত। সূর্যমন্দিরের সামনের একটি গাছের তলায় এসে দাঁড়িয়ে থাকত সারা দুপুর। রাত্রে আসত চুপিচুপি। বলত–আমি তোমাকে দু হাত রাঙানোর প্রচুর মেহেদি পাতা দিতে পারি, ঠোঁট রাঙানোর জন্য দিতে পারি সুগন্ধি পাতা আর পা রাঙাবার প্রসাধন–সব দিতে পারি এবং দামাস্কাসের পাথরের মালা এবং আমাদের প্রসিদ্ধ আতর। আমার জন্য তুমি কি দুয়ার খুলবে না? আমি তোমার জন্য অশ্ব আর। সুর্মা প্রস্তুত রেখেছি। নীল নদীর উপর চাঁদ ঝুলে আছে–এসো আমরা সম্বন্ধ পাতাই। তুমি আমার বোন। এসো বিয়ে করি।
মুখে ছেলেটির এ ছাড়া কোন কথাই ছিল না। যেন মরু-দোয়েল। ক্রমাগত শিস দিয়েই চলেছে। মরু-চাতকের মতই ছিল আবীরুদের পিপাসা। পাখির সেই ডাকে মন খারাপ করত। পিরামিডের নিঃসঙ্গ চূড়াকে আর্তস্বরে প্রদক্ষিণ করত পাখিটি।
এই পাখিটিই যেন আবীরুদ। অথচ আবীরুদের সঙ্গে আপন বোন দীনার বিবাহ স্থির ছিল। ভূসম্পত্তি রক্ষা করতে হলে আপন বোনকে বিয়ে করাই বুদ্ধির কাজ। নমরু যখন জানতে পারল তার ছেলে তারই রক্ষিতা দেবদাসী রিবিকার। প্রেমে আসক্ত হতে চলেছে, তার হৃদয়ে পিরামিড ভেঙে পড়ল।
মিশরীয়রা উট পছন্দ করে না। কিন্তু অশ্বে তাদের অশেষ ভক্তি। কারণ যুদ্ধপ্রিয় হিত্তীয়রা অশ্বশিক্ষা জানে–অশ্ব সবচেয়ে দ্রুতগামী এবং শক্তিশালী পশু। উট শ্লথগতি এবং বিকটদর্শন। একজন মিশরীয় যুবক যখন তার। প্রেয়সীকে অশ্বের কথা বলে, তখন সে তার আভিজাত্য আর আধুনিক মনের পরিচয় দেয়। রিবিকা ছিল উট-পূজকের রক্ষিতা এবং দেবী ইস্তারের মত দুর্ভাগা। ফলে তার সূর্যমন্দিরে আশ্রয় হয়েছিল। তার প্রতি একজন ভূপতি। সূর্যপুরোহিত আসক্ত হতে পারে, কিন্তু সে তার ছেলের সঙ্গে সেই ‘সদকা’ নারীর বিবাহ কস্মিনকালেও দিতে পারে না।
তথাপি একদিন রাত্রে আমারনার মন্দির থেকে রিবিকা আবীরুদের সঙ্গে ঐরাবত মন্দির (এলিফেনটাইন) দুর্গের এলাকায় অশ্বধাবিত হল। রাত্রির উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত নদী নীল। তারই কিনারা ধরে ছুটে চলল অশ্ব। বসন্তের দীপ্র হাওয়ায় রিবিকার মাথার চুল উল্লসিত আবেগে কম্পিত হল ছন্দে ছন্দে। সে আবীরুদকে পিছন থেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে অশ্বের তীব্র বেগ সামাল দিচ্ছিল–এই তার অনিঃশেষ স্মৃতি, উষ্ণ আর উতল।
যখন মিশর আক্রান্ত হল, ইহুদের উম্মতরা নিস্তার-পর্ব পালন করল, নিশান-মাস এল–আগুন লাগল সিবিকাদের ঘরে ঘরে–আবীরুদ নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারল না। একটি বর্শা এসে তাকে বিদ্ধ করে মাটিতে ফেলে দিল। সেই বর্শা ছুঁড়েছিল মিশরীয় বণিক পুরোহিত নমরু। অসুররা আবীরুদকে মারেনি। পিতার হাতে পুত্রের জীবননাশা হয়েছিল। নমরু থুৎকার দিয়ে বলেছিল–এ মাগী বেশ্যা। দেবতা আমন তোকে ঘৃণা করে। ইহুদ ছাড়া তোকে নেবার কেউ নেই।