আমি খবরের কাগজ পড়ি না।
ভালো কথা। খুব ভালো কথা। আমি ভেবেছিলাম খবরের কাগজ পড়ে তারপর এসেছ। নাও, এইখানে আছে। আগে পড়, তারপর কথা বল।
খবরটা পড়লাম। ছবিও সত্যি-সত্যিই ছাপা হয়েছে। তবে বলে না দিলে বোঝা মুশকিল যে, এ মাসুম। আরো তিনটি ছেলে এবং গোটা দশেক মেয়ের সঙ্গে তোলা গ্রুপ ছবি। অসামাজিক কার্যকলাপের জন্যে পুলিশ এদের ধরেছে।
পড়লে নিউজটা?
জ্বি, পড়লাম।
আমার বাবা ছিলেন মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল। সারাজীবনে একটা মিথ্যা কথা বলেন। নি। এক ওয়াক্ত নামাজ কাজ করেন নি। কারোর কি এই ঘটনা জানতে বাকি থাকবে, তুমিই বল! সারা বাংলাদেশের লোক এই ছবি দেখবে না?
সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে?
না, এই একটাতেই ছাপা হয়েছে। পত্রিকাটাই হচ্ছে ফাজিল ধরনের। আজেবাজে নিউজ দিয়ে ভর্তি থাকে। এই নিউজ কি ফার্স্ট পেইজে আসার মতো নিউজ? নিউজ করেছিস করেছি, এত বড় একটা ছবি দেয়ার দরকার কি?
আমি সান্তানার সুরে বললাম, মাসুমকে কিন্তু ছবিতে চেনা যাচ্ছে না। আপনি বলে না-দিলে চিনতে পারতাম না।
ভদ্রলোক কিছুটা আশ্বস্ত হলেন বলে মনে হল। গলার স্বর খানিকটা নামিয়ে বললেন, তোমার অনার্সের রেজাল্ট কি?
এটা হচ্ছে আমাকে যাচাই করবার একটা চেষ্টা। আমি কী ধরনের ছাত্র। মাসুমের লেভেলের না উঁচু লেভেলের সেটা জেনে নেওয়া।
আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, খুব একটা ভালো করতে পারি নি। অবশ্যি ফার্স্ট ক্লাস ছিল। এই সরল মিথ্যাটি বললাম ভদ্রলোককে আরো ঠাণ্ডা করে দেবার জন্যে। আশা করা যাচ্ছে মাসুমের প্রতিও তিনি খানিকটা সদয় হবেন। ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছেলে তার ভাগ্নের বন্ধু, কাজেই ভাগ্নে খুব-একটা খারাপ হতে পারে না।
ফার্স্ট ক্লাস ছিল?
জ্বি।
গুড, ভেরি গুড। ভোমরা থাকতে পর এই অবস্থা কেন বল দেখি। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। ঘরে আমার বড়-বড় মেয়ে। খবরের কাগজ তো তারাও পড়েছে। কি ভাবছে কে জানে। তুমি বস, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
আমি বসলাম।
বেলের সরবত খাবে? আমার স্ত্রী বানাচ্ছে। খাও একটু। পেট ঠাণ্ডা থাকবে। খুব উপকারী জিনিস।
তের-চৌদ্দ বছরের সুন্দর একটা মেয়ে এসে বেলের বরবত দিয়ে গেল। মাসুমের মামা অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কথা বলতে লাগলেন, আমার স্ত্রী কমপ্লেইন করত, সে প্রায়ই নাকি মাসুমের মুখ থেকে মদের গন্ধ পায়। উল্টা আমি তাকে ধমক দিতাম। আমি বলতাম—মদের গন্ধ তুমি চেন নাকি? এখন তো মনে হচ্ছে সবই সত্যি! গাঁজাটাজাও বোধহয় খায়।
জ্বি-না, গাঁজা খায় না।
খায়, খায়। একদিন আমি নিজে তার ঘরে ঢুকে বিকট গন্ধ পেলাম। নাঢ়ি উল্টে আসে।
সস্তা সিগারেট খায় তো! ঐ সিগারেটের গন্ধ। নন-স্মোকারদের কাছে ঐ গন্ধই মনে হয় গাঁজার গন্ধ।
তাইবা খাবে কেন? নেশার পেছনে এই বয়সেই সে পয়সা খরচ করবে কেন? এ হচ্ছে আমার বড় বোনের ছেলে। অল্পবয়সে তিনটা বাচ্চা নিয়ে বোন বিধবা হল। সেভেন্টি ওয়ানের বিধবা। সবাই ধরে-বেঁধে আবার বিয়ে দিল। এই হাজব্যান্ড বাচ্চাগুলি দেখতে পারে না। কী আর করব? আমরা ভাগাভাগি করে বাচ্চাগুলি নিয়ে নিলাম। এই হারামজাদাটা পড়ল আমার ভাগে। অথচ যখন প্রথম আনি তখন কী শান্ত ছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত।
আমি চুপ করে রইলাম। মাসুম সম্পর্কে এইসব তথ্য কিছুই জানতাম না। মাসুমের মামা বলছেনও বেশ সুন্দর করে। শুরুতে লোকটাকে যত খারাপ মনে হচ্ছিল,
এখন দেখছি তা নয়। লোকটা ভালো মানুষ।
মাসুম কি এখন হাজতেই আছে নাকি?
আরে না! হাজতে থাকবে কি! সকালে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছি। ছোটাছুটি দৌড়াদৌড়ি। আজ অফিস কামাই হয়ে গেছে।
ও গেছে কোথায়?
যাবে আবার কোথায়? মোড়ের চায়ের দোকানে বসে আছে। দুপুরে ভাত খাবার জন্য ডেকে পাঠিয়েছে, আসে নি। তেজ দেখাচ্ছে। চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিলে তেজ কমবে। হারামজাদা।
মামা, আমি তাহলে উঠি–দেখি ওকে পাই কি না।
আমার মামা ডাকে ভদ্রলোক একেবারে গলে গেলেন। আমাকে এগিয়ে দেবার জন্যে গেট পর্যন্ত চলে এলেন। নিচু গলায় বললেন, বুঝিয়ে-সুজিয়ে পাঠিয়ে দিও। আর তোমার বন্ধু-বান্ধবরা সৎ পরামর্শ দিও। বাপ-নেই ছেলে। মাও তো বলতে গেলে নেই।
মাসুম মুখ লম্বা করে বসে আছে
মাসুম মুখ লম্বা করে বসে আছে। আমাকে দেখে উঠে এল না। যেভাবে বসেছিল সেভাবেই বসে রইল। তার সামনে চায়ের কাপ। চায়ে চুমুক দেয় নি। ভরা কাপে দুতিনটা সিগারেটের টুকরো ভাসছে। আমি তার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, তুই তো বিখ্যাত হয়ে গেলি! ফ্রন্ট পেইজে ছবি চলে এসেছে।
মাসুম ফিক করে হেসে ফেলল। যেন আমার কথায় মজা পেয়ে গেছে। সে হাসিমুখেই বলল, পাকেচক্রে আটকে পড়ে গেলামরে দোস্ত। ভিক্টোরিয়া পার্কে ব্যাপারটা ঘটল। আমি দরদাম কী করে হয় ঐটা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখছি। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। দুই ধরনের মেয়ে আছে। এক ধরনের মেয়েদের হচ্ছে ফিক্সড় প্রাইস, অন্য আরেক ধরন আছে মাছের দামের মতো। দরাদরি হতে থাকে। আমি হাঁ করে দেখছি। ফট করে এসে পড়ল পুলিশ। কুড়িটা টাকা পকেটে থাকলে পুলিশের হাতে দিয়ে চলে আসতে পারতাম, কিন্তু এমনই কপাল, পকেটে পয়সা ছিল না।
আমি বললাম, পুলিশ কি তোকে ধোলাই দিল নাকি?
তেমন না। অল্পস্বল্প। পেটে একটা মাইন্ড ঘুসি। মুখেও দুএকটা মারলস ধরনের।
ঠোঁট তো মনে হচ্ছে ফাটিয়ে দিয়েছে। হাসতে এখন বোধহয় অসুবিধা হয়। হয় না?