সে দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরিয়ে চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবতে শুরু করল।
প্রিয় মিস্টার অ্যান্ডারসন,
জলরঙে আঁকা আপনার একটি ছবি পাঠালাম। ছবিতে আপনি এবং ইমন মাছ ধরছেন। আমার ছেলেটিকে আপনি যে মমতা এবং স্নেহ দেখিয়েছেন, সে তা মনে রেখেছে এবং আমার কাছে প্রতিটি গল্প অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে করেছে। আপনি আমার পুত্রের প্রতি যে স্নেহ দেখিয়েছেন তা যেন বহুগুণে আপনার কাছে ফিরে আসে, আমি সেই প্রার্থনা করছি। ইমনের কাছে শুনে শুনে আমি আপনার একটি রূপক ছবি আমার মনে তৈরি করেছি। ছবিটি বটবৃক্ষের। যেন আপনি ছায়াদায়িনী বিশাল বটবৃক্ষ। আমার ছোট্ট ইমন তার ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে।
আমার দুর্ভাগ্য আমি আমার পুত্রকে কোনো ছায়া দিতে পারি নি। আমি একজন পরাজিত পেইন্টার। পরাজিত মানুষ ছায়া দিতে পারে না, কারণ তারা নিজেরাই ছায়া খুঁজে বেড়ায়।
আপনি আমার এই চিঠি পড়ে ভাববেন না যে আমি ছেলেকে কাছে না পেয়ে খুব মনঃকষ্টে থাকি। মানুষ অতি দ্রুত সমস্ত পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ইমন কেমন আছে, কী করছে–এইসব সেন্টিমেন্টাল বিষয় নিয়ে ভাবি না। শুধু তার জন্মদিনে ৯ ইঞ্চি বাই ১২ ইঞ্চি ইজেলে মনের সুখে লেমন ইয়েলো রঙ মাখাই। তার জন্মের পর-পর আমি তার নাম রেখেছিলাম
লেমন ইয়েলো। শওকত হঠাৎ হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে বিরক্ত মুখে উঠে দাঁড়াল। মনে মনে লম্বা চিঠি ফেঁদে বসেছে। কোনো মানে হয়? কাকে দিয়ে অনুবাদ করাবে? তারচে নিজেই একটা কাগজে লিখবে— With complements. from Imons dad. কিংবা শুধু লেখা থাকবে— With complements নিচে সে তার নাম সই করবে।
ইমন জেগে উঠেছে। বাবার সন্ধানে সে চলে এসেছে বারান্দায়। শওকত বলল, Hello!
ইমন বলল, Hello! Good morning.
আজ তোমার জন্মদিন। Happy birthday baby.
থ্যাংক য়্যু।
জন্মদিনে কী করতে চাও?
জানি না।
আমেরিকায় কীভাবে জন্মদিন করতে?
স্কুলের সব বন্ধুরা আসত। কেক কাটা হতো। গিফট ভোলা হতো।
এর বাইরে বিশেষ কিছু হতো না? আমার ধারণা মিস্টার অ্যান্ডারসন তোমার জন্মদিনে মজার কিছু করেন। ধারণা ঠিক না?
হ্যাঁ ঠিক। উনি ক্লাউনের পোশাক পরে ম্যাজিক শো করেন। উনি ম্যাজিক জানেন না-কি? খুব ভালো ম্যাজিক জানেন। আর তোমার মা? সে বিশেষ কিছু করে না?
কিছুই করে না?
মা শুধু কেক কাটার সময় তোমার হয়ে আমার কপালে চুমু দেয়।
আমার হয়ে চুমু ব্যাপারটা ব্যাখ্যা কর।
মা বলে, লেমন ইয়েলো। হ্যাপি বার্থডে। তুমি তো আমাকে লেমন ইয়েলো নাম দিয়েছিলে, আমার জন্মদিনে মা একবার এই নামে আমাকে ডাকে।
শওকত শান্ত গলায় বলল, এতটা সম্মান তোমার মা আমাকে দেয়— এটা আমি চিন্তাও করি নি। যাও হাত-মুখ ধুয়ে আস। জন্মদিনে আমরা কী করব ঠিক করে ফেলি। তোমার মাকে দাওয়াত করে নিয়ে আসি।
মা আসবে না।
অবশ্যই আসবে।
আসবে না। মা আগেই বলে দিয়েছে এই জন্মদিনটা আমি যেন শুধু তোমার জন্যে করি।
শুধু তুমি আর আমি জন্মদিন করব?
তুমি তোমার বন্ধুদের বলো। তোমার বন্ধু নেই?
শওকত বলল, না। এক সময় অনেক বন্ধু ছিল, এখন আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই।
কারো সঙ্গেই যোগাযোগ নেই?
অনেকের সঙ্গে হঠাৎ পথে দেখা হয়। তাদের বাসার ঠিকানা জানি না। শুধু একজনের ঠিকানা জানি তৌফিক। ধানমণ্ডিতে থাকে। বড় পেইন্টার হিসেবে নাম করেছে।
উনাকে আসতে বলো। তুমি কি আমার জন্যে কোনো গিফট কিনেছ বাবা?
না।
গিফট কিনতে হবে। মিস্টার অ্যান্ডারসন তুমি আমাকে কী গিফট দেবে সেটা আমাকে গোপনে বলেছেন। আমি দেখতে চাই তার কথা ঠিক হয় কি না।
ইমন মিটিমিটি হাসছে। বাবাকে বড় ধরনের চিন্তার মধ্যে ফেলে দিতে পারায় সে খুব মজা পাচ্ছে।
আজকের নাশতা বাইরে থেকে এসেছে। কিং বিরানি হাউসের তেহারি। বাংলাদেশের এই খাবারটা ইমনের পছন্দ হয়েছে। ইমনের ধারণা এই খাবারটা ম্যাকডোনাল্ডের বার্গারের কাছাকাছি। সে অবশ্যি তেহারি বলতে পারে না। বলে তোহারি।
নাশতার মাঝখানে আনিকা এসে উপস্থিত। সে ঢুকল বিব্রত ভঙ্গিতে। ইমন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম বাবার বাসায় সে বাইরের কাউকে আসতে দেখল।
আনিকা ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল, ইমন, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি। শুভ জন্মদিন।
ইমন বলল, থ্যাংক ব্যু।
আমি তোমার জন্যে জন্মদিনের গিফট এনেছি। জানি না তোমার পছন্দ হবে কি-না।
কী গিফট এনেছ?
কচ্ছপের বাচ্চা।
কিসের বাচ্চা? কচ্ছপের বাচ্চা। কচ্ছপ চেন না! Turtle.
তোমাদের এখানে Pet shop আছে?
আছে।
আনিকা হ্যান্ডব্যাগের ভেতর থেকে পানি ভর্তি হরলিক্সের বোতল বের করল। বোতলের ভেতর ছোট ছোট দুটা কচ্ছপের বাচ্চা উঠা-নামা করছে। ইমন মুগ্ধ গলায় বলল, Oh my God. What a surprise! ইমন হাতের চামচ ছুড়ে ফেলে ছুটে এসে হরলিক্সের বোতল হাতে নিল।
আনিকা বলল, উপহার পছন্দ হয়েছে?
ইমন বলল, খুব পছন্দ হয়েছে। am so happy.
আমাকে ধন্যবাদ দিলে না তো?
আমি এত খুশি হয়েছি যে ধন্যবাদ দিতে ভুলে গেছি। মিস, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।
আমাকে মিস কেন বলছ? আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমার এখনো বিয়ে হয় নি?
হ্যাঁ।
আনিকা শওকতের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তো তোমার ছেলের জন্মদিনে আমাকে আসতে বলবে না, আমি নিজ থেকে চলে এসেছি। ভয় নেই, বেশিক্ষণ থাকব না। আমার অফিস আছে, আমি অফিসে চলে যাব।