কাউবয় ডাকেন কেন?
জানি না। বড়শি দিয়ে ট্রাউট মাছ ধরার ব্যাপারে তিনি অ্যাক্সপার্ট। একবার উনি একটা ট্রাউট মাছ ধরেছিলেন, সেটা আমার চেয়েও বড়।
বলো কী!
আমরা সেই ট্রাউট মাছটা দিয়ে কী করেছি শুনলে তুমি খুব মজা পাবে।
বলো শুনি।
আমরা করলাম কী, শুকনা কাঠ জোগাড় করে আগুন করলাম। তারপর মাছটাকে পোড়ালাম। খেতে গিয়ে দেখলাম, উনি লবণ আনতে ভুলে গেছেন। মাছ মুখে দিয়ে আমরা থুথু করে ফেলে দিলাম। উনি মাছটার উপর ভীষণ রেগে গেলেন।
মাছের উপর রেগে গেলেন কেন? মাছটা তো কোনো ভুল করে নি। ভুল উনি করেছেন। লবণ আনেন নি।
মিস্টার অ্যান্ডারসনের এরকমই স্বভাব। যে দোষী, তিনি তার উপর রাগ করেন না। অন্যের উপর রাগ করেন। মাছটার উপর তিনি ভয়ঙ্কর রেগে এফ ওয়ার্ড দিয়ে গালি দিলেন।
এফ ওয়ার্ডের গালিটা কী?
তিনি বললেন, Fuck you fish. Fuck you হলো এফ ওয়ার্ডের গালি। খুব খারাপ গালি। তুমি কি এই গালি আগে শুনেছ?
হ্যাঁ, শুনেছি।
এফ ওয়ার্ডের গালি ছাড়াও তিনি অন্য গালিও জানেন। যেমন SOB.
SOB আবার কেমন গালি?
SOB হলো Son of a bitch. বাবা, তোমার কি চা খেতে ইচ্ছা করছে? চা বানিয়ে আনব?
আনো। চিনি আধা-চামচ বেশি দেবে। রাতের চায়ে আমি চিনি বেশি খাই।
ইমন চা বানাতে গেল। শওকত তাকিয়ে থাকল ছবিটার দিকে। ছবি ভালো হয় নি। বুড়ো মানুষটাকে আলখাল্লা পরানোর কারণে তাকে লাগছে রবীন্দ্রনাথের মতো। অবচেতন মনে কোথাও হয়তো রবীন্দ্রনাথ ছিল। সেই রবীন্দ্রনাথ উঠে এসেছেন। তার অর্ধেক শরীর পানির নিচে। অর্ধেক উপরে। তিনি পিশাচের মতো চোখে বনভূমির দিকে তাকিয়ে আছেন। কী কুৎসিত!
ইমন চা নিয়ে এসে দেখে, তার বাবা কালো রঙ ঢেলে ছবি নষ্ট করছেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি অন্যরকম।
শওকত ছেলের দিকে তাকিয়ে আহত গলায় বলল, ছবিটা আঁকতে পারি নি। পরে এঁকে দেব। ঠিক আছে?
ইমন বলল, ঠিক আছে।
আজ রাতেই এঁকে রাখব। ঘুম থেকে উঠে তুমি ছবি দেখতে পাবে।
ইমন বলল, ঠিক আছে। তুমি চা খাও। সিগারেট এনে দেব?
দাও।
রাতে ইমনের ঘুম ভালো হলো না। যতবারই তার ঘুম ভাঙল, সে দেখল তার বাবা ছবি আঁকছেন। তার চোখ লাল। চোখে কেমন পাগল-পাগল দৃষ্টি। একবার তার ইচ্ছা করল বলে, বাবা, ছবি আঁকতে হবে না। এসো ঘুমিয়ে পড়ো। এই কথাটাও সে বলতে পারল না।
ইমনের ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। ঘুম ভেঙে সে দেখল, তার বাবা তার পাশে বিছানায় বসে আছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার খুব বড় কোনো অসুখ হয়েছে। গা থেকে অসুখ-অসুখ গন্ধও আসছে। শওকত ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা সরি। ছবিটা আমি আঁকতে পারি নি। আমি ছবি আঁকা ভুলে গেছি।
মতিয়ুর রহমানকে আজ অতি আনন্দিত মনে হচ্ছে
মতিয়ুর রহমানকে আজ অতি আনন্দিত মনে হচ্ছে। এমনিতেই তিনি আনন্দে থাকেন। তাঁর মুখভর্তি পান। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। পান-সিগারেট কিছুদিন আগে ছেড়ে দিয়েছিলেন। দুটাই আজ ধরেছেন। ঘরে পান ছিল না। দোকান থেকে পাঁচ খিলি জরদা দেয়া পান এনেছেন। সেই পাঁচ খিলির তিনটা শেষ হয়ে গেছে। তাঁকে আবারো পান কিনতে যেতে হবে।
মতিয়ুর রহমানের আনন্দের কারণ তার বড় মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলে ভালো। গ্রামে খামারবাড়ি করেছে। দুটা পুকুর কাটিয়েছে। পুকুরে মাছের চাষ হয়। হাঁস-মুরগি গরু-ছাগল নিয়ে থাকে বলেই বোধহয় চেহারায় চাষা চাষা ভাব আছে। সেটা কোনো বড় ব্যাপার না। পুরুষের পরিচয় চেহারায় না, কর্মে। ছেলে কর্মবীর।
বিয়ের এই প্রস্তাব এসেছে মিতুর শ্বশুরবাড়ির দিক থেকে। মিতুর শ্বশুর ওয়াজেদ আলী খোঁজখবর করে বের করেছেন। তাদের দিক থেকে সামান্য আত্মীয়তাও আছে। ওয়াজেদ আলী মানুষটাকেও মতিয়ুর রহমান খুব পছন্দ করেছেন। ওয়াজেদ আলীর যে পরিচয় পেয়েছেন, তাতে মনে হয়েছে না এতদিনে মনের মতো একজনকে পাওয়া গেছে।
ওয়াজেদ আলী গলা নামিয়ে বলেছেন, বুঝেছেন বেয়াই সাহেব, আমাদের বয়স হয়ে গেছে। বেশিদিন নাই। যে-কোনো সময় আজরাইল এসে বলবে, এই শুওয়ের বাচ্চা, উঠ। সময় হয়েছে। বলবে না?
বলবে তো বটেই।
শেষ কয়েকটা দিন যদি আমরা একটু রঙঢঙ করি, অসুবিধা আছে?
অসুবিধা কী?
ওয়াজেদ আলী আনন্দিত গলায় বললেন, সার কথা বলে ফেলেছেন। জগতের সার কথা হলো— অসুবিধা কী? তোমরা ইয়াংম্যানরা যদি ফুর্তি করতে পার, আমরা কেন পারব না? আমাদের দাবি আরো বেশি। আমাদের দিন শেষ। দিন শেষ কি-না বলেন?
অবশ্যই দিন শেষ।
এখন যদি এই শেষ বেলায় মাঝে-মধ্যে সামান্য ওষুধ খাই, কার বাপের কী? নিজের পয়সায় ওষুধ খাচ্ছি। তোর পয়সায় তো না।
মতিয়ুর রহমান বললেন, ওষুধ জিনিসটা বুঝলাম না।
ওয়াজেদ আলী বললেন, না বোঝার কী আছে! যে ওষুধ খেলে মনে আনন্দ হয়, রাতে ঘুম ভালো হয়, সেই ওষুধ। এখনো বুঝেন নাই?
বুঝেছি।
কোকের সঙ্গে মিক্স করে নিয়ে এসেছি। খাবেন না-কি এক টোক? গরমের সময় ভালো লাগে।
মতিয়ুর রহমানের খেতে খুবই ইচ্ছা করছে, তারপরেও বললেন, না থাক।
ওয়াজেদ আলী বললেন, আপনি না খেলে আমিও খাব না। এই জিনিস একা একা খেলে আর ওষুধ থাকে না, তখন হয়ে যায় বিষ।
মতিয়ুর রহমান তখন বেয়াইকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে ওষুধ মেশানো কোক বেশ খানিকটা খেয়ে ফেললেন।
ওষুধের গুণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, খামারবাড়ি দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। বেশ কয়েকবার বললেন, এই ছেলে কর্মবীর, আসল কবীর। আমার মেয়ের সঙ্গে যদি বিয়ের কথাবার্তা না হতো, তাহলে আমি এই ছেলের পা ছুঁয়ে সালাম করতাম। কদমবুসি করার মতো ছেলে।