সাইকিয়াট্রিস্ট রেবেকার দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, আপনাদের বিবাহিত জীবনে প্রথম বড় ধরনের সমস্যা কখন হলো? মানে কোন সে ঘটনা?
রেবেকা শান্ত গলায় বলল, যে দিন তার ওয়েল পেইন্টিং-এ আমার চেহারার মেয়েটির রহস্য পরিষ্কার হলো সেদিন।
রহস্যটা কী?
আমার এক কাজিন আছে এয়ারফোর্সে। পাইলট। সে আমাকে আমার জন্মদিনে উপহার দেবে বলে আমার ছবি দিয়ে একটা ছবি ইমনের বাবাকে আঁকতে বলে। আমার একটা বড় ছবি সে-ই ইমনের বাবাকে দিয়ে আসে। ছবি আঁকা হয়। কিন্তু আমার কাজিনকে তখন এয়ারফোর্স থেকে পাঠিয়ে দেয় সোভিয়েট ইউনিয়নে কী একটা ট্রেনিং-এ। সে আর ছবিটা ইমনের বাবার কাছ থেকে নিতে পারে নি।
ছবির পেছনের এই রহস্য আপনি আপনার স্বামীর কাছ থেকে জানতে পারেন, না-কি আপনার কাজিন আপনাকে বলেন?
আমার কাজিন আমাকে বলেন। ইমনের বাবা পুরো ব্যাপারটা গোপন করেছিল।
পেইন্টিংটা কি আছে আপনার কাছে?
না। যেদিন আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়, সেদিনই আমি ছবিটা নষ্ট করে ফেলি।
এখন কি মনে হয় না কাজটা ভুল হয়েছে?
না, মনে হয় না।
আপনি কি ভেবে-চিন্তে বলছেন, না-কি রাগ করে বলছেন?
আমি ভেবে-চিন্তেই বলছি। রাগ করে বলছি না। ছবিটা অবশ্যই সুন্দর ছিল। কিন্তু সেই সুন্দরের মধ্যে ছিল প্রতারণা। প্রতারণা আমার পছন্দ না। সুন্দর প্রতারণা সহ্য করে না।
আপনি নিজে কখনো কারো সঙ্গে প্রতারণা করেন নি?
না, আমি কখনোই কারো সঙ্গে প্রতারণা করি নি।
নিজেকে নিজে প্রতারণা করেন নি?
তা হয়তো করেছি।
ইমন কাঁচি দিয়ে এখনো কাগজ কাটছে। তবে কাগজ কাটতে গিয়ে সে তার হাত কেটে ফেলেছে। মোটামুটি ভালোই কেটেছে। বেশ কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়েছে। ইমন রঙিন কাগজের একটা টুকরা রক্তের উপর দিয়ে রেখেছে, যাতে ব্যাপারটা মায়ের চোখে না পড়ে। রেবেকা ব্যাপারটা দেখেছেন। তার মন খারাপ হয়েছে। ছেলেটা এরকম হচ্ছে কেন? ব্যথা পেয়েছে সে বলবে। চিক্কার করবে। কাঁদবে। নিজেকে আড়াল করবে কেন?
ইমন। তাকাও আমার দিকে।
ইমন তাকাল। রেবেকা হাত কাটা প্রসঙ্গ তুলতে গিয়েও তুললেন না। ছেলে তাকে কিছু জানাতে চাচ্ছে না যখন, তখন আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করার দরকার কী! রেবেকা বললেন, তোমার চাইনিজ লণ্ঠনের কতদূর? আর কতক্ষণ লাগবে?
বুঝতে পারছি না।
কাগজ কাটতে কি অসুবিধা হচ্ছে? আমি কেটে দেব? Do you need my help?
না।
আগামীকাল তোমার বাবা তোমাকে নিতে আসবেন। তুমি কি তা জানো?
ইমন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
তুমি যা যা সঙ্গে নেবে সব গুছিয়ে নাও।
আমি গুছিয়ে রেখেছি।
কখন গোছালে?
ইমন জবাব দিল না। রেবেকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। ইমন নিজে নিজেই তার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখেছে। তার মাকে কিছু জানায় নি। বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্যে যে ব্যস্ততা তার মধ্যে আছে, সে তা মার কাছে গোপন করছে। কেন করছে? তার কি ধারণা মা রাগ করবে?
ইমন শোন, তোমার কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে তোমার বাবাকে জানাবে। তুমি যে নিজ থেকে কিছু বলল না— তা তো তোমার বাবা জানে না। আমি তোমার স্বভাব জানি বলেই তোমার দিকে লক্ষ রাখি। তোমার বাবা তা রাখবে না। ঠিক আছে?
হুঁ।
এই যে তুমি হাত কেটে ফেলেছ, আমি ব্যাপারটা দেখেছি। তোমার বাবা দেখবেও না। পুরুষমানুষ এত খুঁটিয়ে কিছু দেখে না।
কেন?
প্রকৃতি ছেলেদের একরকম করে বানিয়েছে আর মেয়েদের অন্যরকম করে বানিয়েছে।
কারা বেশি ভালো?
তোমার কী ধারণা? কারা বেশি ভালো?
জানি না।
না জানলেও তোমার নিজের একটা চিন্তা আছে। সেই চিন্তাটা বলছ না। কারণ, তোমার ধারণা তুমি যা ভাবছ তা বললে আমি রাগ করব। তোমার চিন্তায় ছেলেরা বেশি ভালো। ঠিক বলেছি বাবা?
হুঁ।
এখন লক্ষ্মীছেলের মতো আমার ঘরে যাও। আমার ড্রয়ার খুলে ব্যন্ড এইড নিয়ে এসো। তোমার কাটা হাতে লাগিয়ে দিচ্ছি।
ইমন ব্যন্ড এইড নিয়ে এলো। রেবেকা ছেলের হাতে ব্যন্ড এইড লাগাতে লাগাতে বললেন, বাংলাদেশ তোমার কেমন লাগছে?
ইমন বলল, ভালো লাগছে।
বাংলাদেশের কোন জিনিসটা ভালো লাগছে?
সব ভালো লাগছে।
বাহ্ ভালো তো। কোন জিনিসটা খারাপ লাগছে?
লিজার্ড। ঘরের দেয়ালে ঘুরে বেড়ায়।
এই ধরনের লিজার্ডকে আমরা বলি টিকটিকি। তুমি যে টিকটিকি ভয় পাও, তা অবশ্যই বাবাকে আগেই বলে দিও।
আচ্ছা।
আমি তোমার সঙ্গে একটা সেল ফোন দিয়ে দেব। সেল ফোন কীভাবে ব্যবহার করতে হয় শিখিয়ে দেব। কোনো সমস্যা হলেই আমাকে টেলিফোন করবে।
হুঁ।
ইমন আবার রঙিন কাগজের কাছে বসল। রেবেকাও ছেলের কাছে এসে বসলেন। হাসিমুখে বললেন, চাইনিজ লণ্ঠন বানানো কোথায় শিখেছ?
ইমন বলল, স্কুলে। আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট ক্লাসে। মা, আমার কিছু শক্ত কাগজ লাগবে।
কী রকম শক্ত কাগজ? ওয়ান মিলিমিটার থিক হার্ড বোর্ড।
আমি আনিয়ে দিচ্ছি। আমাকে বলে দাও কী করতে হবে। আমি তোমাকে সাহায্য করি।
ইমন বলল, না।
রেবেকা বললেন, না কেন?
ইমন বলল, চাইনিজ লণ্ঠনটা আমি বাবার জন্যে নিয়ে যাব গিফট। আমি একা বানাব।
তুমি তো একাই বানাচ্ছ। আমি শুধু তোমাকে সাহায্য করব।
ইমন শান্ত গলায় বলল, না।
শওকত বলল, হ্যালো, কে অনিকা
শওকত বলল, হ্যালো, কে অনিকা?
আনিকা জড়ানো গলায় বলল, আমার নাম অনিকা না। আমার নাম আনিকা। একটা আকার আছে।
তুমি আজ অফিসে যাও নি?
না।
শরীর খারাপ না-কি?