আমি চোখ বন্ধ করলাম এবং মনে মনে বলতে থাকলাম–ওয়ান থাউজেন্ড ওয়ান, ওয়ান থাউজেন্ড টু, ওয়ান থাউজেন্ড খ্রি…। কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে আছি সেই আন্দাজ পাওয়ার জন্যই বলা। ওয়ান থাউজেন্ড ওয়ান বলতে এক সেকেন্ড সময় লাগে।
ওয়ান থাউজেন্ড থাটি পর্যন্ত আমি চোখ বন্ধ করে আছি। অর্থাৎ প্ৰায় ৩০ সেকেন্ড চোখ বন্ধ। অনেকখানি সময়। চোখ খুললাম।
রুবা বসে আছে। তবে এখন সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে পলকহীন চোখে। ঈষৎ হং করে আছে। জিভ দেখা যাচ্ছে। জিহবার রঙ এখনো গাঢ় কালো।
যে বসে আছে সে রুবা নয়। She is dead… Dead and gone… অন্য কেউ। আমি টেলিফোনের কাছে রাখা চেয়ারে বসে পড়লাম, আর তখনই রুবা স্পষ্ট করে বলল, পানি খাব।
সে কি সত্যি কথা বলছে, না। আমি ভুল শুনছি? অডিটরী হেলুসিনেশন। আমার মাথা বোধহয় জট পাকিয়ে গেছে। সে আবারো বলল, পানি খাব।
আমি লক্ষ করলাম, কথাগুলি বলার সময় তার ঠোঁট নড়ল না, জিহবা, নড়ল না। গলার স্বর রুবার মতোই, তবে অস্পষ্ট, জড়ানো।
আমি বললাম, পানি খাবে?
হুঁ, তিয়াশ হয়েছে।
রুবাই কথা বলছে। তিয়াশ শব্দটা রুবার শব্দ। এটা রুবা বলে। আমি কী করব? পানি এনে দেব? আমার পক্ষে এমন হাস্যকর কিছু করা কি সম্ভব? আমি পানি এনে দিচ্ছি একটা মৃতদেহকে। আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, রুবা!
श्।
তুমি বেঁচে নেই। তুমি মারা গেছ। You are dead. Dead like a stone.
পানি খাব।
তুমি আমার কথা বুঝতে পারছি? আমি তোমাকে মেরে ফেলেছি।
ও।
তুমি শুয়েছিলে। আমি একটা বালিশ এনে তোমার মুখের ওপর চেপে ধরেছি।
ও।
তুমি যে মাবা গেছ তা কি বুঝতে পারছি?
পানি।
পানি আমি তোমাকে এনে দেব। তুমি ভেব না। আমি তোমাকে দেখে আতঙ্কে অস্থির হয়েছি। আমার ভয় খুব কম। অন্য যে কেউ এই অবস্থায় এটফেল করে মরে যেত। আমি মবি নি এবং আমি কথা বলছি তোমার সঙ্গে। আমি কি বলছি বুঝতে পারছি? বুঝতে পারলে মাথা নাড়াও।
রুবা মাথা নাড়ল না। যেভাবে বসেছিল। সেভাবেই বসে রইল।
আমি খাবার ঘরে ঢুকলাম। প্রথমে বের করলাম ব্ৰান্ডিব বোতল। পুরো কাপ। ভর্তি করে ব্ৰান্ডি ঢালিলাম। ব্ৰান্ডির জন্য আলাদা গ্রাস আছে। গ্লাস বের করতে ইচ্ছা করছে না। অতি দ্রুত স্নায়ুর উপর দিয়ে ঝড় বইয়ে দিতে হবে। তখন শরীর ঠিক হবে। সব ফিরে যাবে আগের জায়গায়। ব্যাক টু দি প্যাভিলিসন।
কাপের ওপর পিপড়া ভাসছে। ভাসুক। পিপড়া খাওয়া ভালো। পিপড়া খেলে সাঁতার শেখা যায়। আচ্ছা, আমি কি সাঁতার জানি? সাঁতার জানি কি জানি না। অনেক ভেবেও মনে করতে পারলাম না। তার মানে আমার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। মুখ ভর্তি ব্ৰান্ডি নিয়ে গিলে ফেললাম। জিহবা, নাড়ি-চুড়ি জ্বলতে লাগল। জুলুক। জ্বলে ছাই হয়ে যাক।
এই, এই!
রুবা ডাকছে। পানি খেতে চায়। তাকে পানি খেতে দেব, না এক কাপ ব্ৰান্ডি দেব?
কেউ পানি চাইলে নিষেধ করতে নেই। কেউ পানি চাইলে তাকে পানি দিতে হয়, পানি না দিলে রোজ হাশরের ময়দানে যখন তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যাবে তখন পানি পাওয়া যাবে না। এই কথা বলতেন। আমার মা। কোনো ভিখিরি পানি চাইলে আমার মা অতি ব্যস্ত হয়ে বলতেন–মিজান, ও মিজান! বাপধন, পানি দিয়ে আয়। টিনের মধ্যে টেস্ট বিস্কুট আছে। বিস্কুট দিয়ে পানি দে।
ভিখিরিদের পানি খাওয়ানোর জন্যে আমাদের একটা বড় এলুমিনিয়ামের গ্লাস ছিল। মাসের প্রথমেই বড় একটা টিন ভর্তি টেস্ট বিসকিট কিনে রাখা হতো। অন্য বিসকিটগুলো নরম হয়ে যায়। টেষ্ট বিসকিট কখনো নরম হয় না, যতই দিন যায় ততই শক্ত হতে থাকে–শক্ত হতে হতে এক সময় লোহার মতো শক্ত হয়ে যায়।
একবার এক ভিখিরি ভিক্ষা চাইতে এসেছে–আমি যথারীতি তাকে এক গ্রাস পানি এবং একটা টোস্ট বিসকিট দিলাম। সেই বুড়ো ভিখিরি বিসকিট দেখে আনন্দে অভিভূত হলো। আমি দেখলাম, সে পানিতে বিসকিট ভিজিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছে। লোকে চায়ে বিসকিট ভিজিয়ে খায়, সে খাচ্ছে পানিতে ভিজিয়ে। কিন্তু বিসকিট নরম হচ্ছে না।
আমার মা দিনের পর দিন ভিখিরিদের পানি খাইয়ে গেলেন। নিজে মৃত্যুর সময় পানি খেতে পারলেন না। তার জলাতঙ্ক হয়েছিল। কুকুর তাঁকে কামড়ায় নি–শুধু আদর করে আঁচড়ে দিয়েছিল।
এই কুকুর ছিল মায়ের পোষা। দুপুরের দিকে বাসায় এসে দরজা ধাক্কাতো। মা একটা টিনের থালায় ভাত-মাছ দিয়ে বলতেন–ধর খা।
সে ভাত-মাছ খেয়ে আরাম করে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে বিদেয় হতো। অসুস্থ হবার পর কুকুরটা এলো চোখ লাল করে। কী ভয়ঙ্কর চেহারা! মা বললেন, এই, তোর কী হয়েছে রে? তুই এই রকম করছিস কেন?
কুকুর ঘড়ঘড় আওয়াজ করল। সেই আওয়াজও ভয়াবহ। মা কিছুই বুঝতে পারলেন না। নিজেই টিনের থালায় ভাত বেড়ে দিলেন। কুকুর খাবারে মুখ দিল না। বাপ দিয়ে মার কোলে উঠে তাঁকে আঁচড়ে দিল। মা বিরক্ত গলায় বললেন–করে কী, করে কী? তিনি ছিঃ ছিঃ করে উঠে গেলেন। অবেলায় গোসল করলেন। সন্ধ্যার দিকে তাঁর অল্প জ্বর হলো। পরদিন দিব্যি ভালো। তখনো তিনি জানেন না। তাঁর শরীরে ভয়ঙ্কর বিষ ঢুকে গেছে। যখন জানা গেল তখন করার কিছুই ছিল না।
মৃত্যুর সময় তাঁকে স্টোর রুমে তালাবন্ধ করে রাখা হলো স্টোর রুমের একটা জানালা। সেই জানালায় শিক বসানো। মা দুহাতে শিক চেপে ধরে শ্লেষ্মা জড়ানো ভারি গলায় চিৎকার করতেন, পানি! পানি! রুবা পানি পানি বলছে। তার গলার স্বরটা কি ভারি শোনাচ্ছে না? শ্লেষ্মা জড়ানো মনে হচ্ছে না? না-কি আবারও শোনার ভুল? মার কথাই বা এখন মনে পড়ল কেন? আমি মার কথা মনে করতেই চাই না। মনে করিও না। এটা কি ব্ৰান্ডি খাওয়ার জন্যে হয়েছে? মাথা ঝিমঝিম করছে, শরীর হালকা। এতটা ব্ৰান্ডি এক সঙ্গে খাওয়া ঠিক হয় নি। ভুল হয়েছে। একটা ভুল যদি কেউ করে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সে আরো তিনটা ভুল করে। ভুল একা চলে না, সে চলে সঙ্গিী-সাথি নিয়ে। আমি এখন পরপর কয়েকটা ভুল করব। সেই ভুলগুলি কী কী?