প্রথমবার যখন রুবার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার খবর দিলাম, তখন ওসি সাহেব বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, আপনার স্ত্রী চলে গেছেন, চব্বিশ ঘণ্টাও তো হয় নি, চব্বিশ ঘণ্টা পার না হলে মিসিং পারসন হয় না। ধৈর্য ধরুন। আত্মীয়স্বজনের বাসায় খোঁজ করুন। আমি অত্যন্ত অনুগত গলায় বলেছি, জি আচ্ছা।
সকালের ভেতর খোঁজ না পেলে থানায় চলে আসবেন।
জি আচ্ছা।
আমি সকালবেলায় থানায় চলে গেলাম। ওসি সাহেবকে বললাম, আমার স্ত্রীকে পাওয়া গেছে। ও সকাল আটটার সময় বাসায় এসেছে।
ওসি সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন–দেখলেন তো, আমার কথা। ফলে গেল। এও অল্পতে অস্থির হওয়া ঠিক না।
আর অস্থির হবো না। আমি আপনার জন্যে সামান্য গিফট এনেছি। আপনি কি নেবেন?
ওসি সাহেব বিস্মিত হয়ে বলতেন, কী গিফট?
আমি খবরের কাগজে মোড়া এক কার্টুন বেনসন এন্ড হেজেস এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, আপনাকে গভীর রাতে টেলিফোন করেছি, এই জন্যে…
ওসি সাহেব খুশি খুশি গলায় কপট বিরক্তি মিশিয়ে বললেন, পুলিশকে গভীর রাতে বিরক্ত করবেন না তো কাকে বিরক্ত করবেন? এই জাতীয় সমস্যা হলে টেলিফোন করবেন। যত রাতই হোক, করবেন। আমরা পুলিশরা আছি কী জন্যে?
দ্বিতীয় দফায় আমি আবার রুবার গৃহত্যাগের খবর দিলাম এবং যথারীতি পরদিন ভোরে খবর দিলাম যে, আমার স্ত্রী ফিরে এসেছে। এবারো এক কার্টুন সিগারেট নিয়ে গেলাম।
ওসি সাহেবের সঙ্গে খাতির হয়ে গেল। ওসি সাহেব ধরে নিলেন, আমি নির্বোধ ধরনের ভালো মানুষ গোছের একজন মানুষ, যাকে তার স্ত্রী তেমন পছন্দ করে না বলে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
এ পর্যন্ত চার কার্টুন বেনসন এন্ড হেজেস সিগারেট আমি ওসি সাহেবকে দিয়েছি। এই চার কার্টুন সিগারেটের দাম দুই হাজার পাঁচশ টাকা। এই দুই হাজার পাঁচশ টাকায় আমি এখন যে উপকারটা পাব তার দাম দু লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা।
স্ত্রী খুন হলে প্রথম সন্দেহ এসে পড়ে স্বামীর ওপর। থানার ওসি গোড়াতেই ধরে নেন–স্বামী এই খুনটি করেছে। আমার বেলায় এটা হবে না। ওসি রমনা থানা আমাকে খুনী ভেবে নিয়ে তদন্ত শুরু করবেন না। তিনি ধরেই নেবেন আমি সাতেও নেই পাচেও নেই। একজন মানুষ। আমাকে ঝামেলা থেকে রক্ষা করা তখন তার প্রথম কাজ হয়ে দাঁড়াবে।
মিজান সাহেব।
জি।
চুপ করে আছেন কেন, কথা বলুন, ভাবি কি আবার গৃহত্যাগী?
জি।
আপনি চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়েছেন–রাত তো মাত্র এগারোটা পঁচিশ। সকাল পর্যন্ত ধৈৰ্য ধরে অপেক্ষা করুন এবং বেনসন এন্ড হেজেসের কার্টুন নিয়ে আমার এখানে চলে আসুন। ভাবির গৃহত্যাগ মানে তো আমার লাভ–হা-হা-হা।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো শব্দ করলাম। ওসি সাহেব বললেন, কী হলো?
আমি বললাম, কিছু না। মনটা খুব খারাপ।
আমার একটা উপদেশ শুনুন ভাই সাহেব, স্ত্রীকে কম ভালোবাসবেন। স্ত্রীকে যত কম ভালোবাসবেন ততই কম যন্ত্রণা পোহাতে হবে। ভালোবেসেছেন কি মরেছেন। সম্রাট শাহজাহানের দিকে তাকিয়ে দেখুন, স্ত্রীকে ভালোবেসে কী বিপদে পড়েছে! সব টাকা পয়সা খরচ করে তাজমহল বানাতে হলো–হা-হা-হা। আপনার যা নেচার আমার তো মনে হয় আপনিও তাজমহল-টহল কিছু বানাবেন। মিজান সাহেব!
জি।
আজ। আপনাকে অন্যদিনের চেয়েও মনমরা মনে হচ্ছে। ব্যাপার কী বলুন তো? ঝগড়া কি চূড়ান্ত রকমের হয়েছে না-কি?
জি-না। আজ ওর কাছে লেখা একটা চিঠি হঠাৎ ড্রয়ারে পেয়ে মনটা খারাপ হয়েছে।
চিঠি? কার চিঠি?
বাদ দিন।
না, না। বাদ দেব কেন? আপনি আমার বন্ধু মানুষ। আপনার একটা সমস্যা হলে আমি দেখব না? কী পেয়েছেন বলুন। প্রেমপত্র?
হুঁ।
কে লিখেছে?
বাদ দিন।
নামটা বলুন। খোঁজ নেব। স্ট্রেইট লাইন বানিয়ে ছেড়ে দেব।
ওর নাম মনসুর। আমার ধারণা, রুবা এখন ওর বাসাতেই আছে। চক্ষুলজ্জায় পড়ে খোঁজ নিতে পারছি না।
আপনাকে কোনো খোঁজ নিতে হবে না। আপনি ডেলিকেট অবস্থায় পড়েছেন সেটা বুঝতে পারছি। খোঁজ-খবর আমিই করব। টেলিফোন নাম্বার আছে ঐ লোকের? থাকলে দিন। এক্ষুণি পাত্তা লাগাচ্ছি। তারপরেই আমি আপনাকে জানাব। মন খারাপ করবেন। না ভাই। বি হ্যাপি। লাইফে এরকম হয়।
আমি মনসুরের টেলিফোন নাম্বার দিয়ে দিলাম। এখন বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করছি। মনটা হালকা লাগছে। আমার কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে। আমি এখন যা করব তা হলো…
পানির পিপাসা হচ্ছে। তীব্ৰ পানির পিপাসা। পোলাও খাবার জন্যে এটা হচ্ছে। পানির পিপাসার একটা ব্যাপার হচ্ছে এটা আস্তে আস্তে হয় না। হঠাৎ পিপাসা শুরু হয়। আমি ফ্রিজ খুলে পরপর দু গ্লাস পানি খেলাম। বাথরুম সেরে রাখার জন্যে বাথরুমে ঢুকলাম। দুগ্নাস পানি খেয়েছি, বাথরুম তো পাবেই। বাথরুমের দরজা বন্ধ করা মাত্ৰই হঠাৎ মনে হলো— এখন যদি দরজা আর খুলতে না পারি তাহলে কী হবে? এরকম একটা গল্প কোথায় যেন পড়েছিলাম— বন্ধু একা থাকে, তাকে সে খুন করল। খুনের পর পর তার খুব পিপাসা পেয়ে গেল। সে পুরো এক জগ পানি খেয়ে ফেলল। পানি খাওয়ার পর পর ঢুকাল বাথরুমে। দরজা বন্ধ করে বাথরুম সারল, তারপর আর বাথরুমের দরজা খুলতে পারে না। ছিটিকিনি শক্ত হয়ে এঁটে গেছে। প্রাণপণ শক্তি দিয়েও সে কিছুই করতে পারছে না। পরদিন পুলিশ এসে দরজা খুলে তাকে বের করল। অতিপ্রাকৃত কোনো ব্যাপার এর মধ্যে ছিল না, পুরো ব্যাপারটাই ছিল সাধারণ একটা ব্যাপার। খুনীর শরীর দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। মাংসপেশি হয়েছিল শিথিল। শিথিল মাংসপেশি নিয়ে সে ছিটিকিনি খুলতে পারছিল না। যতই সময় যাচ্ছিল ততই তার শরীর আরো দুর্বল হয়ে পড়ছিল। এর বেশি কিছু না।