টেলিফোন বাজছে। টেলিফোন বাজছে শোবার ঘর থেকে। এর মানে কী? টেলিফোন বসার ঘরে ছিল। তার টেনে শোবার ঘরে কে নিয়ে গেছে? না না এত অস্থির হবার কিছু নেই, নিশ্চয়ই আমিই কোনো এক সময় টেলিফোন শোবার ঘরে নিয়ে গিয়েছিলাম। যেহেতু বড় উত্তেজনার মধ্যে আছি–কিছুই মনে থাকছে না।
আমি টেলিফোন ধবলাম।
একবারও খাটের দিকে তাকালাম না। দবকার কী? টেলিফোন আসায় ভালো হয়েছে–মন কিছুটা হলেও কেন্দ্রীভূত হবে।
হ্যালো!
কে, মিজান ভাই? আমি লীনা–রুবা আপার ঘুম ভেঙেছে?
উঁ।
কী বললেন বুঝতে পারি নি।
একবার ভেঙেছিল, আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।
আপনি কি কাজের মেয়ে দুটির কথা তাকে বলেছেন?
হ্যাঁ।
আপা কী বলল?
কিছু বলে নি। কথা শুনেই আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।
কিছুই বলে নি?
না।
আপনাদের মধ্যে ঝগড়া চলছে না তো? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, রুবা আপা ঘুমের ভান করে পড়ে আছে।
ভান-টান না। গভীর ঘুম।
হ্যালো মিজান ভাই! আমার ধারণা, আপনাদের মধ্যে সিরিয়াস ঝগড়া হয়েছে। বলুন তো ঠিক বলছি কি-না?
আমি কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলাম। অনেকক্ষণ ধরে যে বড় ধরনের বোকামি করছি তা ধরা পড়ল। কেন আমি বোকার মতো বলছি–রুবা ঘুমিয়ে আছে? আমার বলা উচিত, রুবা বাসায় নেই। পুলিশী ঝামেলা হতে পারে। পুলিশ আর কিছু পারুক না পারুক–দুনিয়ার মানুষকে প্রশ্নে প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করতে পাবে। লীনাকে খুঁজে বের করে তারা বলবে–আপনার নাম লীনা?
লীনা ভয়ে আধমরা হয়ে বলবে–জি।
ঘটনার দিন রাতে আপনি টেলিফোন কবেছিলেন। টেলিফোনে কী কী কথা হয়েছিল দয়া করে বলুন। কোনো পয়েন্ট বাদ দেবেন না। ভালো কথা, টেলিফোন কনভারসেসনের কোনো পর্যায়ে কি মিজান সাহেব বলেছেন যে, মিসেস রুবা বাসায় আছেন–ঘুমুচ্ছেন?
এ জাতীয় ঝামেলায় যাওয়াই যাবে না। কাজেই লীনাকে আমার বলে দেয়া উচিত যে, রুবা বাসায় নেই।
হ্যালো মিজান ভাই–আপনি চুপ করে আছেন, কিছু বলছেন না।
কী বলব?
রুবা আপার সঙ্গে কী আপনার ঝগড়া হয়েছে?
হুঁ।
উনি যথারীতি রাগ করে বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। তাই না?
হ্যাঁ।
দেখলেন, আমি কেমন চট করে ধরে ফেললাম? প্রথম যখন আপনাকে টেলিফোন করলাম তখন আপনার গলা শুনেই বুঝে ফেলেছি যে আপনি সত্যি কথা বলছেন না। এখন দয়া করে সত্যি কথাটা বলুন।
ও রাগ করে সন্ধ্যার একটু আগে বাসা ছেড়ে চলে গেছে। আমি খুব দুঃশ্চিন্তায় পড়েছি।
শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা করবেন না। রুবা আপার মার বাসায় খোঁজ করেছিলেন?
করেছিলাম, ওখানে নেই।
তার ছোট বোনের বাসায়?
ওখানে ফোন করি নি। আচ্ছা লীনা…তুমি কিছু মনে করো না, ইয়ে মানে, না থাক…
বলুন না কী বলবেন?
ওর কি কোনো…মানে ইয়ে…
না মানে, কোনো ছেলের সঙ্গে ইদানিং…
লীনা খুব হাসছে। মনে হলো দারুণ মজা পেয়েছে। হাসি থামিয়ে বলল, আচ্ছা! মিজান ভাই, বাড়ির বউদের আপনারা এমন হালকা ভাবেন কেন?
তুমি তোমার আপকে কিছু বলো না যেন। ও মনে কষ্ট পাবে।
কষ্ট তো অবশ্যই পাবে। আমি কিছু বলব না। শুনুন মিজান ভাই, আমি কিছু বলব না। আপনি বোধহয় উড়ো কথাবার্তা শুনেছেন— শুনেই আপনার আক্কেল গুড়ুম হয়েছে।
উড়ো কথা কিছু আছে না-কি?
মনসুর সাহেবকে নিয়ে অনেকোব মধ্যে গুজগাজ ফিসফাস হয়। ঐসব কিছু না।
ও আচ্ছা, মনসুব সাহেবেব টেলিফোন নাম্বার তোমার কাছে আছে?
হ্যাঁ, আছে। আপনি কি সেখানে টেলিফোন করবেন? খবরদার। না।
তুমি টেলিফোন নাম্বারটা দাও না।
দিচ্ছি। আপনি কিন্তু ভুলেও বলতে পাববেন না–কোথেকে টেলিফোন নাম্বার পেয়েছেন।
আচ্ছা, বলব না।
লীনা টেলিফোন নাম্বার দিল। আমি টেলিফোন নাম্বার লিখে রাখলাম, যদিও টেলিফোন নাম্বার লিখে বা খাব কোনো প্রয়োজন ছিল না। এই নাম্বার আমি জানি। টেলিফোন বই-এ লেখা আছে।
যা কবার আটঘাট বেঁধে করতে হবে। কোনো রকম ফাঁক-ফোকর রাখা যাবে না। থানায় টেলিফোন করে বলে রাখতে হবে যে, রুবা বাসা ছেড়ে চলে গেছে। ওসি সাহেব খুব অবাক হবেন না, কারণ এব। আগেও কয়েকবার তাকে রুবার নিখোঁজ হবার খবর দিয়েছি। সবই হচ্ছে বড় পরিকল্পনার অংশ। পরিকল্পনা নিখুঁত করার জন্যে যা যা করণীয়, আমি সবই করেছি। শ্বশুরবাড়িতেও একবার টেলিফোন করা দরকার। আমার শাশুড়িকে জানানো দবকার যে, রুবা বাসায় নেই এবং রুবার সঙ্গে তার কোনো কথা হয় নি।
অনেকবার টেলিফোন করেও আমি শ্বশুর বাড়ির লাইন পেলাম না। রিং করলেই এনগেজড টোন আসে। থানায় টেলিফোন করলাম, সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন ধরল।
রোবট ধরনের গলায় শোনা গেল–ওসি রমনা। স্নামালিকুম।
আমি বললাম, ওসি সাহেব, মিজান বলছি।
ও আচ্ছা, আচ্ছা। কী খরব? কী খ-ব-র?
ওসি সাহেবের খুব আন্তরিক গলা শোনা গেল। এই আন্তরিক গলা শোনার জন্যে আমাকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমার উদ্ভাবনী ক্ষমতা ব্যবহার করতে হয়েছে। আমি এই অবস্থা অনেক পরিকল্পনায় তৈরি করেছি। ওসি সাহেব হাসি হাসি গলায় বললেন, মিজান সাহেব, বলুন, খবর বলুন। ভাবি কি আবারো রাগ করে বাড়ি ছেড়ে গেছেন? হা হা হা।
ওসি সাহেবের এই বিমলানন্দের কারণ হচ্ছে, এর আগে তিনবার আমি থানায় টেলিফোন করে রুবার গৃহত্যাগের খবর দিয়েছি। একটা পরিস্থিতি তৈরি করার জন্যেই এই খবর দেয়া। যাতে পুলিশ যখন রুবার মৃত্যু নিয়ে ফাইন্যাল রিপোর্ট তৈরি করবে, তখন সেই রিপোর্টে উল্লেখ থাকবে–এই মহিলা প্রায়ই রাগারগি করে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেন।