বাসায় ফিরলাম রাত দশটায়। আশ্চর্য কাণ্ড! শোবার ঘরে বাতি জ্বলছে। এর মানে কী? আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি বাতি নিভিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছি। ধ্বক করে বুকে একটা ধাক্কা লাগল। চাবি হাতে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। পায়ের শব্দ পাচ্ছি। ঘরের ভেতর চটি পায়ে কেউ একজন হাঁটছে। নিশ্চয়ই মনের ভুল। বাতিটাও কি মনের ভুল? হয়তো আমি ভুল করে বাতি জ্বলিয়েই এসেছি। পুরো ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। খুব ঠাণ্ডা মাথায়। বোঝাই যাচ্ছে আমার স্নায়ু উত্তেজিত। মাথায় হয়তো রক্ত উঠে গেছে। আমার শ্বশুর সাহেবই বা এটা কী বললেন? সব কিছুর একটা লজিকেল এক্সপ্ল্যানেশন থাকে। এরও নিশ্চয়ই আছে।
আমি দরজা না খুলে রাস্তার দিকে রওনা হলাম। মোড়ে একটা চায়ের দোকান আছে। এক কাপ চা খাব। একটা সিগারেট খাব। পানও খাওয়া যেতে পারে। এই ফাকে চিন্তা করে বের করব।–হচ্ছেটা কী? ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে। ছয়-এর সঙ্গে এক যোগ করলে তবেই সাত হয়–আপনা। আপনি সাত হয় না।
চা খেতে খেতে আমি ব্যাপারটা কী ঘটেছে তার একটা গ্ৰহণযোগ্য সিনারিও তৈরি করলাম।
আমার শাশুড়ি পিঠের ব্যথায় ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়েছিলেন। তার হাতের কাছেই টেলিফোন। তিনি পিঠের ব্যথার জন্য কড়া ধরনের সিডেটিভ খান। কাজেই তাঁর আধোঘুম আধো-জাগরণ অবস্থা। এই অবস্থায় টেলিফোন বাজল। তিনি টেলিফোন ধরার জন্য হাত বাড়ালেন এবং টেলিফোন ধরার আগেই ঘুমিয়ে পড়লেন। রুবার সঙ্গে কথাবার্তার অংশটি তিনি স্বপ্নে দেখলেন। স্বপ্নটা তাঁর অবচেতন মন তাকে দেখাল। স্বপ্ন ভাঙার পর স্বপ্নটাকেই তার সত্যি মনে হতে লাগল। আমার শ্বশুর সাহেব তখন বেরুচ্ছেন। তাকে তিনি রুবার কথাটা বলে দিলেন। সত্যি ভেবেই বললেন। এই হচ্ছে ব্যাপার।
একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো গেছে, এতেই আনন্দিত বোধ করছি। নিশ্চিন্ত বোধ করছি। একটা ব্যাখ্যা যখন দাঁড় করানো গেছে, আরো ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই দাঁড় করানো যাবে।
আমি পান মুখে দিয়ে ফিরে এলাম। তালা খুলে ঘরে ঢুকলাম। কেন জানি ইচ্ছা! করল। দরজাটা খোলা রাখতে। পর মুহুর্তে মনে হলো, এতো বড় বোকামি কখনোই করা ঠিক হবে না। দরজার দুটা ছিটিকিনিই বন্ধ কাবলাম। ডেডবডি সবাবার কাজ এখন শুরু করতে হবে। আমি শোবার ঘরে ঢুকলাম। রুবা ঠিক আগের ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। শুধুশুধুই একটা আজে-বাজে ধরনের ভয়ে এতক্ষণ কুঁকড়ে ছিলাম।
ফ্যানটা বন্ধ করে দিয়েছি বলেই বোধহয় ঘবটা গুমটি হয়ে আছে। ফ্যান ছাড়লাম। বাতাসে রুবার মাথার চুল উড়ছে। সেই চুলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ভয়াবহ ধরনের চমক খেলাম। রুবা তো এভাবে শুয়ে ছিল না। আমি তার মুখ দেয়ালের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। সে পাশ ফিরল কীভাবে? তার চোখও খোলা। চোখ তো বন্ধ ছিল। চোখ খোলা হলেও এই চোখ জীবিত মানুষের নয়। চোখে পলক পড়ছে না। রুবা পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। না না, মেঝের দিকে না। সে তো আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। একটু আগেই তো দেখেছি মেঝের দিকে তাকিয়েছিল। Something is wrong. Something is very very very wrong. গরম লাগছে। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। আমি কি ভয় পাচ্ছি? মানুষেবা ভয় পাওয়ার একটা শেষ সীমা আছে। আমি কি সীমা অতিক্রম করতে যাচ্ছি?
হে মানব সন্তান।
তুমি সীমা অতিক্রম করিও না।
সীমা অতিক্রমকারীকে আমি পছন্দ করি না।
এইগুলি কার কথা? কোরান শরীফের? কোন সূরায় আছে?
নিঃশ্বাস ফেলার মতো শব্দ হলো। কে নিঃশ্বাস ফেলল? রুবা? মৃত মানুষ কখনোই নিঃশ্বাস ফেলে না। আমি যা শুনছি তা আমার নিজেরই নিঃশ্বাসের শব্দ। কিংবা বাতাসের শব্দ। কিংবা…। আমি নিজের অজান্তেই ডাকলাম, রুবা!
সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন বলল, উঁ।
না না, রুবা এটা বলতেই পারে না। ঐ তো তার মুখ হাঁ হয়ে আছে। জিহবা খানিকটা বের হয়ে আছে। পলকহীন চোখে সে তাকিয়ে আছে। মৃত মানুষ কথা বলে না। বাতাসের শব্দই আমার কাছে উ ধ্বনির মতো মনে হয়েছে। আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। আমাকে যা করতে হবে তা হলো–এই ঘর থেকে বের হয়ে যেতে হবে। স্নায়ু ঠাণ্ডা করতে হবে। কাবার্ডে ব্ৰান্ডি আছে। সামান্য ব্ৰান্ডি খাব, তারপর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মাথাটা ধুয়ে ফেলব। আমার মস্তিষ্ক মনে হয় অক্সিজেন কম পাচ্ছে। অক্সিজেন কম পেলে মানুষ হেলুসিনেশন দেখতে শুরু করে।
ঘর থেকে বেরুবার আগে আরেকবার ভালোমতে রুবার দিকে তোকালাম। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিলাম। প্রচুর অক্সিজেন নিতে হবে। ব্রেইনের যেন অক্সিজেনের অভাব না হয়।
আমি বসার ঘরের দিকে রওনা হতেই স্পষ্ট শুনলাম, কেউ যেন পাশ ফিরল। খাট মট মট কবে উঠল। নিঃশ্বাস ফেলাব শব্দও যেন হলো।
কেউ কি থুথু ফেলেছে? একটু থু শব্দ যেন শুনলাম।
আমি বসার ঘরে চলে এলাম। চায়ের কাপোব আধিকাপ ব্ৰান্ডি একসঙ্গে গলায় ঢেলে দিলাম। তীব্র, ঝাধালো স্বাদ! মনে হচ্ছে শরীরের সমস্ত স্নায়ু পুড়িয়ে তরল আগুন নিচের দিকে নামছে। ভয়টা কমে গেছে। জিনিসটা আরো। আগেই খাওয়া উচিত ছিল। আমি জানি, এখন যদি শোবার ঘরে যাই, দেখব, সব স্বাভাবিক। রুবার মুখ দেয়ালের দিকে ফেব্যানো, চোখ বন্ধ। বাথরুমে ঢুকে মাথায় পানি ঢালিলাম। কাজটা বোকার মতো হয়ে গেল। আমার টনসিলাইটিসেব সমস্যা। ঠাণ্ড লেগে বিশ্ৰী ব্যাপার হবে।