এ বাসায় মর্টিন, এরোসল, এয়ার ফ্রেশনার সবই আছে, শুধু খুঁজে বের করাই হলো সমস্যা।
ওয়াস বেসিনের নিচেই এরোসল পাওয়া গেল! একগাদা এরোসল প্রে করলাম রুবার গায়ে। তেলাপোকাটা বিস্মিত হয়ে আমার কাণ্ডকারখানা দেখছে। শুঁড় নাড়ছে।
আমি আয়নার সামনে চলে গেলাম। বিয়েতে যেতে হবে। প্রতিটি কাজকর্ম খুব স্বাভাবিকভাবে করতে হবে। কেউ যেন কিছুই সন্দেহ করতে না পারে। আয়নায় নিজের চেহারায় আমি তেমন কোনো পরিবর্তন দেখতে পেলাম না। একটু ক্লান্ত ভাব আছে, এর বেশি কিছু না। কেউ দেখে বুঝতে পারবে না যে আমি কিছুক্ষণ আগে একটা খুন করেছি।
ঘর থেকে বের হবার আগে রুবাকে পাশ ফিরিয়ে দিলাম। হাঁ করা মুখ দেখতে ভালো লাগছে না। তার শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা। এত ঠাণ্ডা হয় কী করে? ঘরের যে তাপ সেই তাপই তো থাকার কথা। এর চেয়ে ঠাণ্ডা হবার তো কথা না। হাত-পাও শক্ত হয়ে গেছে। রিগরাস মার্টিস শুরু হয়েছে। দাওয়াত থেকে ফিরে এসে ডেডবিডি সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। কী করব। সব ঠিক করা আছে। কোনো সমস্যা হবে না।
বাতি নিভিয়ে ঘর থেকে বের হলাম। বাইরে তালা লাগিয়ে দিলাম। ঘড়িতে এখন বাজছে নটা। নভেম্বর মাসের শেষ, শীত লাগছে। গরম কাপড় আনা উচিত ছিল। দিনের বেলা বেশ গরম ছিল। বাংলাদেশের আবহাওয়া কী হচ্ছে কে জানে? ওজোন লেয়ারের গণ্ডগোলে সব মনে হয় ওলট-পালট হয়ে গেছে। কিছুদিন পর হয়তো দেখা যাবে শীতকালে প্ৰচণ্ড গরম পড়েছে। গরমকালে শীতে লোকজন ঠক ঠক করে কাঁপছে।
অরুণের বিয়ে হচ্ছে
অরুণের বিয়ে হচ্ছে সোহাগ কম্যুনিটি সেন্টারে। অরুণ হলো আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। বন্ধু বললে বাড়িয়ে বলা হয়–স্কুলে আমি ওর সঙ্গে পড়েছি। অরুণের ধারণা, আমি ওর জন্যে খুব ব্যস্ত। এবং আমাদের বন্ধুত্ব আরসিসি কনক্রিটের মতো। সে কদিন পরপরই অফিসে টেলিফোন করে আন্তরিক ধরনের একটা স্বর বের করে বলে–দোস্ত, তোর কোনো খোঁজ নাই, খবর নাই। ব্যাপারটা কী?
বাসায় যখন তখন আসে, ভাবি ভাবি বলে সরাসরি বেডরুমে ঢুকে যায়। তার বোধহয় ধারণা, আন্তরিকতা দেখানোর প্রধান শর্ত হলো বেডরুমের বিছানায় পা এলিয়ে বসে গল্প।
অরুণের ওস্তাদী ধরনের আলাপ আমার সব সময় অসহ্য বোধ হয়। উপায় নেই বলেই সহ্য করে নেই। অরুণটা গাধা ধরনের, আমি যে তাকে দু চোখে দেখতে পারি না এতা সে জানে না।
কম্যুনিটি সেন্টারে পৌঁছে দেখি, দুটা ব্যাচের খাওয়া হয়ে গেছে। তাবপরেও লোকজন যা আছে, মনে হচ্ছে আরো চার-পাঁচ ব্যাচ খাবে। অরুণ আমাকে বলল, তুই গাধার মতো এত দেরি করলি? আশ্চৰ্য, সামান্য সেন্সও তোর নেই? ছাগল কোথাকব! বউ আসে নি?
আমি কিছু বললাম না, হাসলাম।
অরুণ বলল, আবার ঝগড়া? আমার বিয়ের দিনটায় বেছে বেছে ঝগড়া করলি?
মাফ করে দে।
যা, খেতে বোস। তোর শ্বশুর এসেছেন, তোকে খুঁজছেন।
কেন?
কে জানে কেন। তুই খেতে বোস। সবাই যে হারে খাচ্ছে খাওয়া শর্ট পড়ে যাবে। দেরি করলে কিছুই পাবি না। ভিডিও হচ্ছে বুঝলি। মনে করে তোর ভাবির সঙ্গে ছবি তুলিস। একটা রেকর্ড থাকুক।
আমি খেতে বসে গেলাম। এতটা খিদে লেগেছে নিজেও বুঝি নি। রান্না ভালো হয়েছে। অনেকেই দেখি চেয়ে চেয়ে ডাবল বোস্ট নিচ্ছে। আমিও নিলাম। পোলাও বোধহয় নতুন করে বান্না হয়েছে। আগুন-গরম। খাসির বেজালা থেকে চমৎকার গন্ধ আসছে।
এই যে মিজান!
তাকিয়ে দেখি আমার শ্বশুর সাহেব। আমার শ্বশুর সাহেব বিয়ে করার পর হারে বুড়ো হতে শুরু করেছেন। রোজ অনেকখানি করে বুড়ো হন। বিয়ে উপলক্ষ্যে তিনি একটা কালো আচকান পরেছেন। সম্ভবত এই জিনিস যৌবনকালে বানিয়েছেন। আচকানও তাঁর মতো বুড়ো হয়েছে। বেচারাকে দেখাচ্ছে সার্কাসের লোম ওঠা ভালুকের মতো। আমি তাকে দেখে উঠে দাঁড়ালাম। উনি হৈ হৈ করে উঠলেন, দাঁড়াচ্ছ কেন? বোস বোস। রুবা বাসায় আছে এই খবরটা তোমাকে জানাতে বলল তোমার শাশুড়ি।
কে বাসায় ফিরেছে?
রুবা।
তোমার শাশুড়ি তোমার বাসায় টেলিফোন করেছিল। সে ধরল। সে নাকি বাসাতেই ছিল। ঘুমিয়ে পড়েছিল। তুমি তাকে রেখে চলে এসেছ, এই নিয়ে মন খারাপ করেছে।
আমি বুড়োর দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। গাধাটা এইসব কী বলছে? বুড়ো ভালুকের মাথায় নাট বল্টু কি খুলে পড়ে গেছে? কোথায় না কোথায় রং নাম্বার করেছে… ..আমি খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লাম। আমার রুচি নষ্ট হয়ে গেছে।
আমি হাত ধুচ্ছি, অরুণ ছুটে এসে বলল, ব্যাপার কিরে, খাওয়া শেষ?
হুঁ।
খাওয়া কেমন হয়েছে?
ভালো। খুব ভালো।
পোলাও শর্ট পড়ে গিয়েছিল। নতুন করে রাঁধতে হলো। অন্য মানুষদের বিয়েতে গোশত শর্ট পড়ে, রোস্ট থাকে না, রেজালা থাকে না–আমার বেলায় শর্ট পড়ল পোলাও। হাউ ষ্ট্রেঞ্জ।
দোস্ত যাই।
যাই মানে? হোয়াট ড়ু ইউ মীন বাই যাই? তোর ভাবির সঙ্গে দেখা হয়েছে?
না।
যা, দেখা কর। ভিডিওওয়ালাকে বলে দিচ্ছি, ভিডিও করবে।
বাসায় যাওয়া দরকার, রুবার জন্যে চিন্তা লাগছে।
খামাখা চিন্তা করবি না। আয় তো আমার সঙ্গে, তোর ভাবির সাথে আলাপ করিয়ে দেই।
আজকালকার বৌরা আগের দিনের মতো না, জবুথবু হয়ে লম্বা ঘোমটা টেনে বসে থাকে না। এরা হড়বড় করে কথা বলে, বিনা কারণেই হিস্টিরিয়া রোগীর মতো হাসে। অরুণের বৌয়ের হাসি শোনার সময় এখন নেই। আমাকে বাসায় যেতে হবে। এমনভাবে যেতে হবে যেন কারো চোখে কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা না পড়ে।