বাথরুমের বাতি জ্বালালাম। আয়নায় একটা নোটিশ ঝুলছে
ছোট বাথরুম করার আগে দয়া করে
কমোডের ঢাকনা তুলে রাখবেন।
আমি তাই করলাম। রুবা বেঁচে নেই তাতে কী হয়েছে! ওর কথা শুনতে আপত্তি কী? তিনি ১৯-এ কত? ৫৭ না ৫৮? তিন নয়। সাতাশের সাত। হাতে রইল দুই। তিন একে তিন আর দুই পাঁচ…।
মাথা থেকে নামতা ঝেড়ে ফেললাম। বাতি নিভিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে এলাম। এখন আমার যা দরকার তা হলো গরম এক কাপ কফি। কফি খেয়ে শরীরটা চাঙ্গা করে শ্বশুববাড়িতে একটা টেলিফোন করতে হবে। চিন্তিত গলায় বলতে হবেরুবা কি আপনাদের ওখানে গেছে? ও-বাড়ির কেউ তেমন চিন্তিত হবে না। কারণ রুবা প্র৩ি মাসে কয়েকবার রাগ করে বাসা ছেড়ে চলে যায়। কখনো তার মার কাছে গিয়ে থাকে, কখনো তার বোনের বাসায় গিয়ে উঠে। মাঝে মাঝে চলে যায়। তার বন্ধু-বান্ধবদের বাসায়।
কফির জন্যে পানি গরম করতে দিলাম। আমাদের রান্নাঘরও বাথরুমের মতোই ঝকঝকে পরিষ্কার। এক কণা ধূলি নেই, তেলের ছোপ নেই। কিচেন ক্যাবিনেটে সুন্দর করে থরে থরে বোতল সাজানো। প্রতিটি বোতলের গায়ে আবার লেবেল লাগানোচিনি, লবণ, হলুদ, মবিচ, গবাম মশল্লা.। রুবা খুব গোছানো মেয়ে ছিল, এটা স্বীকার করতেই হবে। গত একমাস হবে আমাদের কোনো কাজের লোক নেই, এতে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। বরং লাভ হয়ে গেল আমার। কাজের লোক থাকলে হত্যা পরিকল্পনা রদবদল করতে হতো। তাকে ছুটি দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিতে হতো বা এরকম কিছু করতে হতো। অবশ্যি এতে তেমন ঝামেলা কিছু হতো না। পরিস্থিতি বুঝে পরিকল্পনা। যে কারণে ফ্লাট বাডি ছেড়ে আলাদা একতলা বাড়ি নিলাম। ফ্লাট বাড়ি থেকে একটা ডেডবডি বের করে নেয়া প্ৰায় অসম্ভব ব্যাপার। আর এখানে কোনো ব্যাপারই না। গাড়িবারান্দার বাতি নেভানো থাকবে। গাড়ির দরজা থাকবে খোলা। আমি রুবাকে বড় একটা চাদরে মুড়ে গাড়িতে ঢুকিয়ে দেব।
পানি ফুটছে। কফির ঝামেলায় গেলাম না। আমি কফি ঠিকমতো বানাতে পারি না। তেতো হয়ে যায়। এই মুহুর্তে তেতো কফি খেতে ভালো লাগবে না। এরচে চা বানানো সহজ। একটা টি-ব্যাগ ফেলে দেয়া। চায়ের কাপ হাতে নিয়েই আমি টেলিফোন করতে গেলাম। আমার শাশুড়ি টেলিফোন ধরলেন। আমি বললাম, মা, কেমন আছেন?
তিনি বললেন, ভালো আছি বাবা।
আপনার পিঠের ব্যথা কমেছে?
ব্যথাটা কমেছে, অবশ্যি জ্বর এখনো আছে।
মা, খাওয়া-দাওয়া কী করছেন?
দুপুরে কিছু খাই নি।
কিছু একটা খাওয়া তো দরকার মা–উপোস করা ঠিক না।
কিছু খেতে ইচ্ছা করে না।
আপনার খোঁজ নেয়ার জন্যেই টেলিফোন করলাম মা।
তা তো বাবা করবেই। আমার খোঁজ-খবর যা করার তা তো তুমিই কর। তুমি যা করা কোনো মায়ের পেটের সন্তান তা কবে না।
ছি ছি মা, আমি আবার কী করলাম?
সেই কবে কথায় কথায় খেজ্বর গুড়ের সন্দেশের কথা বলেছিলাম। তুমি ঠিকই মনে রেখেছি। এ ক গাদা সন্দেশ পাঠিয়েছ। তা বাবা, সন্দেশ খাওয়ার বয়স কি এখন আছে?
ঐসব কথা বাদ দিন তো মা?
আচ্ছা বাবা, যাও বাদ দিলাম। রুবা কেমন আছে? ওর কি দিনে একবার মাকে টেলিফোন করতেও ভালো লাগে না?
ও সা সময় বলে আপনার কথা।
থাক বাবা। থাক। আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার দরকার নেই। আমার নিজের পেটেরই তো মেয়ে। আমি জানি না। ওরা কেমন?
ইয়ে মা, রুবা আপনার ওখানে যায় নি? আমি ভাবছিলাম…
ও কি আবার রাগ করে চলে গেছে?
জি।
তুমি ওকে কিছু বলে না কেন? তুমি কিছুই বলো না। এতে সে আরো লাই পেয়ে গেছে। বাবা তুমি শক্ত হও।
আমি হাসলাম। আমার শাশুড়ি এতে রেগে গেলেন। বিরক্ত গলায় বললেন, হাসছ কেন? হসবে না। আমি আমার মেয়েদের নাড়ি-নক্ষত্র চিনি। এরা জানে শুধু যন্ত্রণা দিতে। তোমাকে ভালো মানুষ পেয়ে…
বাদ দিন মা।
কিছু একটা হলেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। এসব কী? বেশি স্বাধীনতা ভালো না। তুমি স্বাধীনতা বেশি দিয়ে ফেলেছ?
থাক মা, আপনি এটা নিয়ে ওকে কিছু বলতে যাবেন না। ও যদি টেলিফোন করে তাহলে বলবেন, ঘরের আলিমিরার চাবি নিয়ে গেছে, আমি কাপড়-চোপড় বের করতে পারছি না। অরুণের বিয়েতে যাবার কথা। মনে হচ্ছে অফিসের কাপড় পরেই যেতে হবে। যেতে অবশ্যি ইচ্ছা করছে না…
না, না, তুমি যাও। অরুণ আমাদেরকেও কার্ড দিয়ে গেছে। আমি পিঠে ব্যথা নিয়ে যাই কীভাবে? তোমার শ্বশুর সাহেবকে যেতে বলছি, দেখি যায় কি না। রুবার ব্যবহারে তুমি কিছু মনে করো না বাবা। তুমি বিয়েতে যাও। তোমার এতদিনের বন্ধু, না গেলে মনে কষ্ট পাবে।
আচ্ছা মা, আপনি যখন বলছেন যাব। সমস্যা হচ্ছে গিফট যেটা কিনেছিলাম সেটাও রুবা আলমিরায় ঢুকিয়ে রেখেছে। ভুল করে রেখেছে বোধহয়।
মোটেই ভুল করে রাখে নি। এই কাজটা সে ইচ্ছা করেই করেছে। তোমাকে সমস্যায় ফেলা, আর কিছু না। বাবা, তুমি দেরি করো না, চলে যাও?
আমি টেলিফোন নামিয়ে আবার শোবার ঘরে এলাম। রুবা শুয়ে আছে। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে বলেই কিছু কিছু চুল উড়ছে। সবই স্বাভাবিক। শুধু মুখ খানিকটা হাঁ হয়ে আছে। দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিহবার খানিকটা অংশ বের হয়ে আছে। মৃত্যুর পরপর মানুষের জিহবা কি খানিকটা লম্বা হয়ে যায়? রুবার শাড়ির আঁচলে একটা তেলাপোকা বসে আছে। এরা কি টের পেয়ে গেছে? বুঝে গেছে যে এই মেয়েটা বেঁচে নেই? তেলাপোকা যখন খবর পেয়েছে তখন পিপড়ারাও খবর পাবে। সারি বেঁধে আসতে শুরু করবে। নকোব ফুটো, কানের ফুটো দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে। একটা ব্যবস্থা নেয়া উচিত। খানিকটা মটিন ছড়িয়ে দিলে হয়।