বাবা আবার গুন গুন শুরু করলেন–সখি হে! সখি হে। বাবার প্ৰিয় গান। গান থামিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, বি হ্যাপি মাই সান।
আমি হ্যাপিই আছি। আপনি চলে যান।
চলে যাব?
হ্যাঁ চলে যাবেন। অবশ্যই চলে যাবেন।
তোকে এমন ব্যামেলায় ফেলে যাব?
হ্যাঁ যাবেন। আমার ঝামেলা আমিই মেটাব। ঝামেলা কবার সময় তো আব্ব আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করে করি নি।
তবু… ..তুই আমার ছেলে। তোর কষ্ট দেখে কষ্ট হয়।
বাবা, আমার কোনো কষ্ট নেই। আপনাকে হাতজোড় কবে অনুরোধ করছি আপনি চলে যান।
আচ্ছা বেশ যাচ্ছি–বৌমার ডেডবডি কীভাবে সরাবি একটু বলে দে। তোর মাকে বলতে হবে তো। গেলেই জিজ্ঞেস করবে।
একটা বস্তায় ভরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসব।
কোথায় ফেলবি?
জানি না কোথায়। এখনো ঠিক করি নি।
আজে বাজে কোনো জায়গায় ফেলিস না। এত ভালো একটা মেয়ে।
ভালো মেয়ে।
অবশ্যই ভালো মেয়ে। সে যে ভালো মেয়ে সেটা আমি যেমন জানি, তুইও জানিস। জানিস না?
বাবা চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলেছেন। তাকাচ্ছেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। বাবার চোখে এই দৃষ্টি সহ্য করা সম্ভব না। কী শীতল, কী ঠাণ্ডা চোখ!
খোকন!
জি বাবা।
তুই অসুস্থ। ভয়ঙ্কর অসুস্থ। জন্ম থেকেই তুই অসুস্থ ছিলি। আমরা বুঝতে পারি নি। তুই যে কাণ্ডটা করেছিস, অসুস্থ বলেই করেছিস। তোর এই অসুখ আরো বাড়বে–তুই এমন কাণ্ড আরো করবি। সেটা কি ঠিক হবে?
ঠিক হবে কি হবে না, তা নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না। আপনি কেউ না।
আমি কেউ না তা কী করে বললি রে ব্যাটা? আমি তোর বাবা না? মনে নেই একবার তোর পেটে যন্ত্রণা হলো–সারারাত তোকে কোলে নিয়ে হোটলাম। তোর মা বলল, কতক্ষণ আর তুমি হাঁটবে–আমার কোলে দাও। আমি খানিকক্ষণ হাঁটি। কিন্তু তুই মার কোলে যাবি না, বানরের বাচ্চার মতো আমার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাইলি–ভুলে গেছিস?
না। ভুলি নি।
তোকে কোলে নিয়ে হাঁটতে আমার কোনো কষ্ট হয় নি। তুই পেটের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলি, সেই জন্যে কষ্ট পাচ্ছিলাম। আমি আল্লাহর কাছে মানত করলাম তোর পেটের ব্যথা সারলে আমি একশ রাকাত নামাজ পড়বা। মানতটা করার সঙ্গে সঙ্গে তোর পেটের ব্যথা কমে গেল।
আপনি মানত অদায় কবেছিলেন?
অবশ্যই। তোকে তোর মার কাছে দিয়ে জায়নামাজে বসলাম। নামাজ শেষ করে। তারপর উঠলাম।
আপনি এত তালো মানুষ কিন্তু আপনার ছেলে এত খারাপ হলো কেন?
সেটা তো বাবা বলতে পারি না। জগৎ বড়ই বিচিত্ৰ। তোর মার কথাই ধর। এমন একজন মহিলা, অথচ কী কুৎসিত মৃত্যু হলো। যে কুকুরটাকে এত আদর করত, তার মরণ হলো কুকুরের হাতে।
আপনি চলে যান তো বাবা।
আচ্ছা যাচ্ছি। বৌমাকে একবার দেখে যাব না?
তাকে দেখাব কিছু নেই।
আহা, একটু দেখে যাই। চোখের দেখা আর কিছু না। মাথা হাত বুলিয়ে আদর করে চলে যাব। ওর পেটে যে একটা বাচ্চা ছিল সেটা বোধহয় তোকে বলে নি। না—কি বলেছে?
আমি কিছু বললাম না। এক দৃষ্টিতে বাবাকে দেখছি। এ কে? সত্যি কি বাবা এসেছেন? না মাথার ভেতরের কোনো ভ্ৰান্তি উঠে এসেছে?
বাবা হাই তুলতে তুলতে বললেন, দুমাসের একটা বাচ্চা ছিল–বৌমা ভেবেছিল তোর জন্মদিনে বলবে। তোকে অবাক করে দেবে। কবে যেন তোর জন্মদিন?
আমি চুপ করে রইলাম। বাবা হাসিমুখে বললেন–আমার মনে হয় আজই তোর জন্মদিন। আমার অবশ্যি দিন তারিখ মনে থাকে না। গুবলেট করে ফেলি। তোর মা ঠিক ঠাক বলতে পারত। একবার ভেবেছিলাম তোর মাকেও নিয়ে আসি। কুকুরে কামড়ানোর পর ওর শরীর ভালো না… এই জন্যেই আনি নি।
বাবা প্লিজ আপনি চলে যান। আমি আপনার পায়ে পড়ছি।
আচ্ছা আচ্ছা, যাচ্ছি। যাচ্ছি। বৌমাকে একবার দেখে যাব না? কখনো দেখি নি।
আচ্ছা যান দেখে যান–ও শুয়ে আছে। ওব সঙ্গে ইচ্ছা করলে কথাও বলতে পারেন। ও এখনো মরে নি, কথা বলে হাঁটে পানি খায়…
গলায় বালিশ চেপে ধরে রাখলে কেউ কি আর বেঁচে থাকে রে বোকা? তুই যা দেখছিস সব মনের কল্পনা। মনের বিকার। তোর স্নায়ু ভয়ঙ্কর উত্তেজিত। এই জন্যেই তোকে নিয়ে এত চিন্তা লাগছে।
আমাকে নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না। আমি ভালো আছি। খুব ভালো আছি। আপনি চলে গেলে আরো ভালো থাকব। যান। আপনার বৌমাকে দেখে চলে যান।
ওর গায়ে একটা কাপড় পরিয়ে দে বাবা। সুন্দর একটা শাড়ি পরিয়ে দে। ছেলের বৌ প্ৰথম দেখছি। ওর বিয়ের শাড়িটা আছে না?
হুঁ আছে।
বিয়ের শাড়িটা পরা, আর কিছু গয়না টয়না পবিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দে। আমি মাকে দেখে চলে যাই।
বাবা আমি এইসব কিছুই করব না।
বাবা, তীব্র গলায় বললেন, তুই অবশ্যই কববি। আমি আমার বৌমার নগ্ন মূর্তি দেখব?
আমি পুরোপুরি হকচকিয়ে গেলাম। এটা স্বপ্ন হতে পারে না। স্বপ্নে এমন তীব্ৰ গলায় কেউ কথা বলে না। স্বপ্ন এত দীর্ঘ ও হয় না। এটা উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনাও না। উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা এত গোছানো হয় না। তাহলে কী হচ্ছে?
খোকন!
জি বাবা।
বৌমাকে বস্তায় ভরে রাস্তায় ফেলে দেওয়া ঠিক হবে না। তোর মা মনে কষ্টে পাবে।
মা তো বেঁচে নেই বাবা।
বাবা বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসলেন। আমি সেই হাসি দেখে চমকে উঠলাম। তার নিজের মৃত্যুর সময়ও তিনি ঠিক এই ভাবে হেসেছিলাম। মৃত্যুর সময় তিনি আমাদের সবাইকে লাইন বেঁধে দাড়া কবালেন। আমাদের প্রত্যেকের মাথায় হাত রেখে খানিকক্ষণ দেয়া করলেন। তারপর বিচিত্র ভঙ্গিতে খানিকক্ষণ হেসে মারা গেলেন।